লেখার বদলে অন্য পেশা বেছে নিলে কী হত? হয়তো ডিমসেদ্ধ বিক্রি করতেন, বলছেন রাস্কিন বন্ড। ছোটদের সঙ্গে মশকরার সুরেই বলছেন এ কথা। আর সেই সূত্র ধরেই পৌঁছে যাচ্ছেন মানুষের যে কোনও কিছু সৃষ্টি করার প্রসঙ্গে। বড় সৃষ্টি মাত্রেই মহৎ নয়, যদি তা অন্যকে ধ্বংস করে। আবার নগণ্য সৃষ্টিও হতে পারে সুন্দর, যদি তাতে থাকে শ্রম আর সততা। নিছক ডিম সেদ্ধ করার প্রসঙ্গেই বড় সত্যকে বুঝিয়ে দিলেন রাস্কিন বন্ড।
আত্মজীবনীর নাম হতে পারত ‘১০১টি ব্যর্থ ওমলেট’! বলছেন খোদ রাস্কিন বন্ড। দিনের পর দিন ধরে যাঁর কলম আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখে গেল হলদে পাখির পালক, যে পালক আমাদের রোজকার জীবনটার গায়ে বুলিয়ে দিল অন্যরকম ছোঁয়া, সেই বন্ড বলছেন ব্যর্থতার কথা। বলছেন, একেক সময় তাঁর মনে হয় যা কিছু লিখেছেন সবই যেন ব্যর্থ। যেন এসব না লিখলেও কারও কিছু এসে যেত না। বদলে তিনি বিক্রি করতে পারতেন ডিমসেদ্ধ, কিংবা বানাতে পারতেন অমলেটও।
আরও শুনুন:
বাইরে বৃদ্ধ-তরুণীর প্রেমের গল্প, নেপথ্যে গভীর রাজনীতির উপন্যাসই জিতল বুকার
খুদে বা তরুণ পাঠকদের উদ্দেশে এ কথা বলছেন রাস্কিন বন্ড। তাঁর নতুন বই ‘হোল্ড অন টু ইয়োর ড্রিমস: আ লেটার টু ইয়ং ফ্রেন্ডস’, যেখানে স্বপ্ন দেখার কথা আর সেই স্বপ্নে থিতু হওয়ার কথা বলছেন তিনি। সেখানেই নিজের স্বপ্নের কথা, সৃষ্টির কথা বলছেন বন্ড। বলছেন, আসলে মানুষ তো কিছু না কিছু সৃষ্টি করেই। কিন্তু মানুষের মেধা আর বুদ্ধি ক্রমাগত এমন কিছু বানানোর দিকে নজর দিয়েছে, যা গোটা মানবজাতিকেই শেষ করে দিতে পারে। অথচ এই মেধার জোরেই তো নিজেকে অন্য প্রাণীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে মানুষ। লেখক বলছেন, তাঁর পোষা বেড়াল মিমির পক্ষে বোমা বানানো সম্ভব হবে না। কিন্তু মানুষ বোমা বানাতে পারে। শুধু তাই নয়, সে বোমা বানিয়ে অন্য মানুষকেও তা ব্যবহার করতে দেয়। তাই বন্ড খতিয়ে দেখছেন, সত্যিই কি আমরা এমন কিছু বানাই, যা সংরক্ষণ করে রাখার যোগ্য? না, তেমনটা মনে করেন না তিনি। বরং বর্ষীয়ান এই লেখক মনে করেন, একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেই আমরা আমাদের সবটুকু উজাড় করে দিচ্ছি।
আর এই প্রবণতার প্রেক্ষিতেই একেক সময় যাবতীয় সৃজনশীল কাজ ব্যর্থ বলে মনে হয় তাঁর। তাঁর মনে হয়, সব মহৎ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তকেরা মানুষের অস্তিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্যই আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। অথচ শেষ পর্যন্ত মানবজাতির সমগ্র অস্তিত্ব এসে দাঁড়াচ্ছে দ্বন্দ্বের উপর। লোভ আর দ্বন্দ্ব, এই আদিম প্রবৃত্তিই যেন হয়ে উঠছে মানুষের নিয়ন্তা। আর সে কথা মনে করলেই হতাশা এসে গ্রাস করে, বলছেন বন্ড। সেসময় তিনি নিজেকে বলেন, জীবনে অন্য কিছু করলেও হয়তো হত। কিন্তু কী করতে পারতেন তিনি?
পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য একাধিক কাজ অবশ্য খুঁজে পান না রাস্কিন বন্ড। কখনও কখনও ভাবেন, ডিমসেদ্ধ বিক্রি করতে পারতেন তিনি। তাঁর বাড়ির কাছাকাছি গ্রাম থেকে যেমন কেউ কেউ এসে মল রোডে দাঁড়ান, পর্যটকদের কাছে ডিমসেদ্ধ বিক্রি করেন। এই বয়সে এসেও ডিম সেদ্ধ করতে পারেন তিনি, আশ্বাস দিচ্ছেন বন্ড। অবশ্য পরে তাঁর এ কথাও মনে হয়, ঠান্ডা বাড়লে পরে খোলা রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বোধহয় তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হবে না, ওই খেটে-খাওয়া মানুষেরা যেমন দাঁড়িয়ে থাকেন।
তবে তিনি তো বন্ডই। কেবল জেমস নন, রাস্কিন বন্ডও জানেন, কেমন করে পেরে উঠতে হয়। তাই সেই মানুষটির কথা তিনি মনে করান, ছোট্ট দোকানে দাঁড়িয়ে দুর্দান্ত অমলেট বানিয়ে বিক্রি করতেন তিনি। বন্ড নিজে অবশ্য কখনোই ভালো অমলেট বানিয়ে উঠতে পারেননি। ব্যর্থ হয়েছেন। এ কথা বলেই বন্ড মনে করিয়ে দেন, ব্যর্থতার জন্য হতাশ হতে নেই। আর হতাশ হলেও, তা পেরিয়ে যাওয়ার জন্যই ফের হাঁটতে হয়।
আরও শুনুন:
ডাকলে বাঙালি যে ঠাকুরের দেখা পায়, তিনিই রবীন্দ্রনাথ
তরুণ পাঠকদের তিনি কোনও উপদেশ দিতে চান না, শুরুতেই বলেছিলেন বন্ড। সেই প্রেক্ষিতে ব্যর্থতার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেই ব্যর্থতায় দাঁড়িয়ে থাকেন না তিনি। ধরে থাকেন না ভুলের স্মৃতিও। বরং যে কোনও ভুল, যে কোনও না-পারা যে আরেকটা নতুন শুরুর ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করার সুযোগ, জীবনের শেষবেলার লেখাতেও সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে চলেছেন রাস্কিন বন্ড। সেই মন্ত্রই তাঁর জাদুকাঠি, ছোটদের হাতে তিনি তুলে দিচ্ছেন যার উত্তরাধিকার।