শোনা যায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নাকি গ্রাম থেকে খুঁজে আনত সুন্দরী মেয়েদের। এছাড়াও বার ড্যান্সার কিংবা সিঙ্গারদেরও বেছে নেওয়া হত এই কাজের জন্য। বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখানো হত তাদের, বিনিময়ে চাওয়া হত যৌনতা! বাছাই করা মেয়েগুলিকে রীতিমত প্রশিক্ষন দিত সংস্থাগুলি। ঠিক কোন কোন উপায়ে নিজস্ব যৌনতার আবেদন বাড়াতে পারবে তারা, তা শেখানো হত হাতে-কলমে। একইভাবে, নিয়োগ করা হত আবেদনময় চেহারার পুরুষদেরও।
গাছ ভরে ফুটে থাকা রংবেরঙের ফুল দেখে মৌমাছিরা আকৃষ্ট হয়। মধু সংগ্রহ করতে ফুলের উপর বসে, আর তখনই তাদের পায়ের রোমে আটকে যায় পরাগ। সেই মৌমাছি অন্য ফুলে বসলে পরাগ মিলন ঘটে। অর্থাৎ, মৌমাছি মধু পেয়ে খুশি, কিন্তু আখেরে লাভ হল সেই ফুলগাছের। আর এ কারণেই যৌনতার টোপ দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তিতে বাধ্য করার পোশাকি নাম ‘হানিট্র্যাপ’। বলা হয়, রাষ্ট্রের গোপন তথ্য বের করতে চাইলে, মাথায় বন্দুক ঠেকানোর চাইতেও নাকি বেশি কার্যকরী, যৌনতার প্রলোভন! আর তাই বলিউড যখন দেখায় যে, নায়কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে চাওয়া নায়িকা আসলে ভিনদেশের গুপ্তচর, তখন তাকে একেবারে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে সে কথার।
সাম্প্রতিক ভারত-পাক দ্বন্দ্বের মধ্যেই উঠে এসেছে জ্যোতি মালহোত্রার নাম। একাধারে ইউটিউবার ও ভ্লগার জ্যোতি নাকি গোপনে তথ্য পাচার করছিলেন পাকিস্তানে। এক উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তার সঙ্গে প্রেমজ সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল তাঁর, দাবি সংবাদমাধ্যমের। আন্দাজ করা হচ্ছে, ভারত সংক্রান্ত ‘সেনসিটিভ ইনফর্মেশন’ আদায়ের উদ্দেশে হানিট্র্যাপ করা হয়েছিল জ্যোতিকে। অর্থাৎ, ভালোবাসা ও যৌনতার আশায় বাঁধা পড়েছিলেন তিনি। আর তাঁর দুর্বল মুহূর্তগুলিকে কাজে লাগিয়েই ভারতের নানান গোপন তথ্য পাচার হয়েছে সীমান্তের অন্যপারে। এ প্রসঙ্গেই এসেছে ইসলামাবাদের ইন্ডিয়ান হাই কমিশনে সেকেন্ড সেক্রেটরি পদে কর্মরতা মাধুরী গুপ্তার নাম, যিনি বছর পনেরো আগে একেইভাবে পা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের বিছানো মধু-ফাঁদে!
এর তল খুঁজতে গেলেই বোঝা যায়, গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে প্রেমের ফাঁদ পাতা কোনও নতুন বিষয় নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই রমরম করে চলে এসেছে এই প্র্যাকটিস। শোনা যায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নাকি গ্রাম থেকে খুঁজে আনত সুন্দরী মেয়েদের। এছাড়াও বার ড্যান্সার কিংবা সিঙ্গারদেরও বেছে নেওয়া হত এই কাজের জন্য। বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখানো হত তাদের, বিনিময়ে চাওয়া হত যৌনতা! বাছাই করা মেয়েগুলিকে রীতিমত প্রশিক্ষন দিত সংস্থাগুলি। ঠিক কোন কোন উপায়ে নিজস্ব যৌনতার আবেদন বাড়াতে পারবে তারা, তা শেখানো হত হাতে-কলমে। শোনা যায়, সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা নাকি সেখানে প্রশিক্ষনরত মেয়েদের বোঝাত যে, এক অর্থে তারাও সে দেশের সৈনিক, আর শরীরই তাদের সবচাইতে বড় অস্ত্র! শত্রুদেশের উচ্চপদে কর্মরত আধিকারিকদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করত এই মেয়েরা, আর তারপর যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য আদায় করে নিত।
একইভাবে, এই কাজে নিয়োগ করা হত আবেদনময় চেহারার পুরুষদেরও। সরকারি দপ্তরগুলিতে কর্মরত মাঝবয়সি মহিলারা, যারা সাধারণত একাকিত্বে ভোগেন, তাদেরকেই বেছে নিত পুরুষ গুপ্তচররা। কেবল যৌনতা নয়, রীতিমত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলত সময় নিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে বছরের পর বছর গড়িয়ে যেত সঙ্গের প্রেমিকাটির থেকে গোপন তথ্য বের করতে। এমনকি এই প্রেমের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্তও গড়িয়ে যেতে দেখা গিয়েছে ঘটনাবিশেষে। এ থেকে বলাই যায় যে গুপ্তচরটি সত্যি করেই নিজেকে দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত বলে মনে করেছেন। এই তালিকায় রাখা যায় ইস্ট জার্মান স্ট্যাসি-র বিশেষ দপ্তর ‘রোমিও স্পাইস টু’-কে। ব্রিটিশ এমফিফটিন আবার একান্তে যোগাযোগের চাইতে গুরুত্ব দিত এমন সব জায়গাকে, যেখানে সহজেই জনসমাগম হয়ে থাকে। বেলজিয়ামের ‘ইভ ক্লাব’ যেমন পুরোপুরিভাবে সেক্স-স্পাইদের আড্ডাখানা হিসেবেই ব্যবহার করা হত।
ফলত বলা চলে যে পৃথিবী জুড়ে এই যে মধুফাঁদের এত রমরমা, এর পিছনে কারণ হিসেবে রয়েছে মানুষের আবেগই। উচ্চপদে কাজ করা কিংবা বিপুল ধনসম্পদের মালিক হওয়ার পরেও মানুষ দিনশেষে কেবল ভালোবাসাই খুঁজে বেড়ায়। কেউ বা জীবনের একাকিত্ব কাটাতে যৌনতা আঁকড়ে ধরতে চায়। কোনও মানুষ যদি অসহায় মুহূর্তে সঙ্গে থাকে, যার কাছ থেকে প্রেম অথবা যৌনতা পাওয়া যায়, মানুষ তবে বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের একান্ত গোপনীয় তথ্য বিলিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। একাকিত্ব নিরসনের উপায়টির সামনে বুঝি দেশাত্মবোধও ফিকে হয়ে যায় মুহূর্তখানেকের জন্য। আর তাই সময়ভেদে অন্য সমস্ত রকমের প্রলোভনের আবেদন যদি কমেও যায়, লাস্যময়তার আবেদন কমে না কখনওই!