ওরাও থাকুক। একসঙ্গে, মিলেমিশে, ঠিক আগের মতো। কিন্তু জায়গা কোথায়? উদ্যোগ নিল পড়ুয়ারাই। স্কুলবাড়িই হয়ে উঠল হাজার হাজার চড়াই পাখির ঠিকানা। কীভাবে সম্ভব হল এমনটা? কোন স্কুলের পড়ুয়ারা ঘটালো এমন কাণ্ড? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
চারিদিকে উঁচু ইমারত। গোটা শহরটাই কংক্রিটের জঙ্গল। কোথাও জায়গা নেই এতটুকু। ধীরে ধীরে তাই হারিয়ে যেতে বসেছে চড়াই, কাক, ঘুঘুর মতো পাখিরা। পরিবেশের জন্য এমনটা অশনি সংকেতই বটে। সাবধান করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবার ফুরসত কোথায় বড়দের! তাই এগিয়ে এল ছোটরাই। পাখিদের থাকার ব্যবস্থা করে দিল খুদের দলই।
পরিবেশ রক্ষার বিষয়টা অনেকেই তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। এই নিয়ে আলোচনা হয় ঠিকই, তবে লাভের গুড় খেয়ে যায় সেই পিপড়ে। অর্থাৎ যে সমস্যার সমাধানে এত আলোচনা, তা রয়ে গেল যে কে সেই। চড়াইয়ের সংখ্যা কমে যাওয়া এমনই এক সমস্যা। যা লক্ষ করেছেন অনেকেই, কিন্তু সেই অর্থে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেননি। নিজের কাজ ছেড়ে এমনটা করার ফুরসত নেই কারও। তবু সবাই ভাগ্যিস এক গোত্রের নন। কেউ কেউ নিজের কাজ হিসেবেই এগুলোকে দেখেন, তাঁদের উদ্যোগে নতুন করে সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন দেখে পরিবেশ। এমনই একজন মানুষ চেন্নাইয়ের ডি গনেশন। ছোট থেকেই পরিবেশের প্রতি বড় টান তাঁর। গাছ হোক বা পাখি সবকিছু আগলে রাখতে চান দু-হাত দিয়ে। বড় বয়সে তৈরি করেছেন এক বিশেষ এনজিও- যাদের মূল কাজ পরিবেশ সংরক্ষন। তবে আরও একটা কারণে গনেশনকে নিয়ে চর্চা হতেই পারে। ঠিক ধরেছেন, চড়াই পাখির প্রসঙ্গেই বলছি। ইনিই সেই ব্যক্তি, যার নিজ উদ্যোগে চেন্নাই সহ ওই অঞ্চলের চড়াই পাখির সংখ্যা ১৫% বেড়েছে। যেখানে দেশের অধিকাংশ শহরে দূরবীন দিয়ে খুঁজলেও চড়াইয়ের দেখা মেলা ভার হবে, সেখানে চেন্নাইয়ের বিভিন্ন স্কুলে ঢুকলেই চোখে পড়লে একগুচ্ছ চড়াই পাখি। কিঁচির মিচির শব্দ কানে আসবে সবসময়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্কুল কেন?
আসলে, চড়াই সংরক্ষণের বিষয়টা সবাইকে বোঝাতে চেয়েছিলেন গনেশন। কেন প্রয়োজন, চড়াইয়ের ভূমিকা কী, এতে মানুষের কী লাভ, সবকিছু সুন্দর ভাবে বলতে চেয়েছিলেন গনেশন। অনেকে শুনেছেন, অনেককে শোনেননি, তবে মোটের উপর সকলেই তেমন আমল দেননি। কেউ কেউ মুখের উপর জানিয়ে দিয়েছেন এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব না। অথচ খুব বেশি কিছু যে করতে হত তা নয়। ঘরের কনে বা অন্য কোথাও চড়াইয়ের থাকার ব্যবস্থা করে দিন, এমনটাই বড়দের দোরে দোরে ঘুরে বলে বেড়াতেন গনেশন। পাত্তা দেননি প্রায় কেউই। এক্ষেত্রে অবশ্য চড়াই পাখি পোষার কথা হচ্ছে না। গনেশন বুদ্ধি খাটিয়ে এক বিশেষ বাক্স তৈরি করেছিলেন। দেখতে খানিকটা লেটার বক্সের মতো- যা তৈরি করা হয়েছে চড়াইদের থাকার জন্য। কেমন পরিবেশ এই গোত্রের পাখিরা পছন্দ করে তা ভালোকরে জেনে নিয়ে বাক্স বানিয়েছিলেন গনেশন। সাধ করে নাম দিয়েছিলেন ‘কোদুগল নেস্ট’। চেয়েছিলেন তাঁর মতো আরও অনেকে এগিয়ে আসবে এই বাক্স তৈরি করতে। নিজেদের মতো করে বাক্স বাড়ি নিয়ে গিয়ে ঠাঁই দেবে চড়াই পাখিদের। একটা বাক্সে অনায়াসে দুটি চড়াই থাকতে পারে। অন্তত ১০০০ জন বাক্স বানালেও বড় সংখ্যায় চড়াই সংরক্ষণ সম্ভব হত। তবে কারও কাছে পাত্তা না পেয়ে গনেশন হাল ছাড়তে বসেছিলেন। এমন সময় তাঁর মাথায় আসে পড়ুয়াদের কথা। স্থানীয় কিছু স্কুলে গিয়ে নিজের দাবির কথা জানান। প্রায় সব স্কুল কর্তৃপক্ষই তাতে সম্মতি জানায়। আর পড়ুয়ারা? প্রবল উচ্ছ্বাসে কোদুগল বানাতে শুরু করে। ব্যাস, আর কি চাই! ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকল শয়ে শয়ে চড়াইয়ের বাড়ি। তারপর নিয়ম মেনে সেসব রাখা হল স্কুল বাড়িতেই। একটা সময়ের পর তাতে ভিড় জমাতে শুরু করল চড়াই পাখিও।
বর্তমানে চেন্নাইয়ের প্রায় ৪০-৪৫ টি স্কুলে এমন বাক্স রয়েছে। খুব কম করেও দশ হাজার হবে সংখ্যায়। গনেশনের দাবি, এর প্রায় ৭০% বাক্সে চড়াই রয়েছে। আগামীদিনে সেই সংখ্যা আরও বাড়বে। যে স্বপ্ন নিয়ে চড়াই সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছিলেন এই পরিবেশপ্রেমী, তা আজ অনেকটাই সফল। তবু থামতে চান না গনেশন, তাঁর ভাবনা ছড়িয়ে দিতে চান আগামী প্রজন্মের মধ্যে। যাতে আর কখনও বাড়ির হবে হারিয়ে যেতে না হয়, চড়াইয়ের দলকে।