চটুল হাস্যরস নয় বরং তীব্র সমালোচনা থাকত তাঁর তুলিকলায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজের ব্যঙ্গচিত্র চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর কাছে। তিনি আর কে হতে পারেন! স্বয়ং আর কে লক্ষ্মণ! তাঁর অমর সৃষ্টি ‘কমন ম্যান’। আম জনতার প্রতিনিধি। সেই কমন ম্যান-এর জন্ম কীভাবে হয়েছিল জানেন?
ভোট হোক অথবা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। বাজেট হোক কিংবা সবজি বা গ্যাসের দাম বাড়া – সবসময় কপাল পোড়ে আমজনতার। খবরের কাগজে হেডলাইন হয়। টিভি চ্যানেলে বিতর্ক বসে। বিরোধী পক্ষ যখনই যাঁরা থাকেন, তাঁরা গলা ফুলিয়ে মিছিলে মিটিং-এ বলেন, ‘সরকার সাধারণ মানুষের কথা ভাবছে না।’ কে এই সাধারণ মানুষ! কোনও বিশেষ চরিত্র! বয়স কত! ধর্ম-বর্ণ বা লিঙ্গ কী! ভোটের সময় যারা নেহাত সংখ্যা। তারাই আমজনতা, ইংরেজিতে ‘কমন ম্যান’। এই জনতার আসলে নেই কোনও জাতি-ধর্ম-বর্ণ। আমজনতার সমস্যা, সবসময়ই এক, একই ধরনের। এটাই বোধহয় ছিল আর.কে. লক্ষ্মণের ‘কমন ম্যান’-এর জন্মের প্রথম ধাপ।
প্রথাগত আঁকা শিখতে গিয়ে প্রত্যাখাত হয়েছিলেন মুম্বইয়ের জে.জে স্কুল অফ আর্টসে। সে সময়ের কলেজের অধ্যক্ষ বলেছিলেন, ‘এখানে ভর্তি হতে যে যোগ্যতা লাগে, সেই যোগ্যতার ছিটেফোঁটা তাঁর নেই’। প্রথাগত পড়াশোনা শুরু করলেন। দাদা, সাহিত্যিক আর. কে. নারায়ণ-এর সাহায্য পেলেন। দাদার বিখ্যাত গল্প ‘মালগুড়ি ডে’জ’-এর সঙ্গে ছবি এঁকে হাত পাকাতে লাগলেন। স্থানীয় সংবাদপত্রেও রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে শুরু করলেন। প্রথম জীবনে মুম্বইয়ের একটি সংবাদপত্রে সহকর্মী হিসেবে সঙ্গ পেয়েছিলেন শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের। তারপর একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে বেশ বেশি মাইনেতেই কার্টুনিস্ট হিসেবে যোগদান।
শুরুতেই যদিও তিনি কমন ম্যান আঁকেননি। নিজের লেখাতেই তিনি জানিয়েছেন, ‘ভারতের মতো বিশাল দেশের বহুধা বিস্তৃতি এবং ঐক্য বোঝাতে তিনি শুরুতে প্রচুর ক্যারেকটার আঁকতেন।’ জনতার ভিড়ে দেখাতেন মানুষের বিচিত্র-বৈচিত্র্য। তারপর জনতা সরিয়ে ক্রমশ বৃত্ত ছোট করতে থাকেন। একজন বিশেষ কাউকে খুঁজছিলেন যাকে কেন্দ্র করে দেখানো যায় সমগ্র কার্টুনকে। যাকে দেখে মনে হবে, ‘এ আমাদেরই লোক’। আমাদের সুখ দুঃখের সাথি। সমগ্র দেশের সবকিছু নির্বিশেষে মানুষের সাধারণ প্রতিনিধি। সাধারণ মানুষ, যারা রোদে পোড়েন, জলে ভেজেন। লোকাল ট্রেনের হাতল ধরে ঝোলেন। বাসের ধারে একটা সিট পেলে, মন খুশি হয়ে যায়। বাজারে বা কন্ডাক্টরের সঙ্গে ভাড়া বা দাম নিয়ে দরাদরি করেন, তাঁদের মানুষ, তাঁদের একজন।
লক্ষ্মণের ভাবনায় আসে, এক অবয়ব। টুইলের শার্ট, ধুতি, পায়ে ক্যানভাসের জুতো। খ্যাংরা গোঁফ। টাকমাথায় এক গোছা সাদা চুল। হাতে ছাতা। গায়ে চেকচেক কাপড়ের কোট। আমাদের আশেপাশের সাধারণ মধ্যবিত্তর চেহারা হয় যেমন। আমাদের আশেপাশের ভিড়ের মধ্যের এক চরিত্র। সেই মানুষকে লক্ষ্মণ আনলেন, তাঁর কার্টুনে। যে কোনও ঘটনায় তিনি শরিক। প্রায় নীরবে দেখতে থাকেন শুধু। সবকিছুরই সাক্ষী, কিন্তু থাকেন একেবারেই চুপ।
কমন ম্যান সবখানেই আছেন। গ্রামের সমস্যা। আমলা বা মন্ত্রী সকাশে, বদ ব্যবসায়ীর দুর্নীতির সাক্ষী হয়ে, অর্থনীতির বিশেষজ্ঞের মতামতে, অধিকারের জন্য আন্দোলনরত ছাত্র অথবা ধর্মঘটী শ্রমিক-দের সঙ্গে, স্বমহিমায় সবখানেই তাঁর অবাধ বিচরণ। আর এই অবাধ বিচরণের জন্য সমস্ত মুন্সিয়ানা প্রাপ্য আরকে-র।
ক্রমেই জনতার দরবারে চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘কমন ম্যান’-এর কার্টুন। হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের জাতীয় প্রতীক।
আরও শুনুন: টুক করে পাঠিয়ে তো দেন Emoji, মানে না জানলে কিন্তু পুরোটাই Emotional Atyachar!
এমন কার্টুন তৈরির ক্ষেত্রে স্টাইল বা বিষয় নির্বাচনে লক্ষ্মণ কি কাউকে পথিকৃৎ মানতেন?
শিল্পী নিজে সাক্ষাৎকারে দু একবার বলেছেন, শিল্প-আলোচকরা বলেছেন, ব্রিটেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কার্টুনিস্ট ডেভিড লো-র কাজ থেকে অনুপ্রাণিত ছিল তাঁর ধরন। যদিও লো-র কাজে থাকত যৎসামান্য ডিটেইল। লক্ষ্মণের কাজে অত্যন্ত যত্নে তৈরি অজস্র ডিটেইল তাঁর কাজকে সরলতা ও তীব্রতা দুই-ই দিত সমানভাবে।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে এইভাবে তিনি আপামর ভারতবাসীর ড্রয়িংরুমে শরিক হয়েছিলেন। কখনও কাউকেই রেয়াত করেননি। যে কোনও বিষয়েই মতবাদ নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বারবার পেনসিল এবং তুলির আঁচড়ে বিদ্ধ করেছেন। নেহাত হাস্যরস নয়, বরং সেখানে থাকত কঠোর সমালোচনা থাকত। খানিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো করেই। সেইসব নেতা মন্ত্রীরা চটে থাকবেন এ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু উলটপুরাণ হয়েছে অনেকবারই।
১৯৬২ সাল। সদ্য শেষ হয়েছে চিন ভারত যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে বিঁধে এঁকে চলেছেন, একের পর এক কার্টুন। একদিন সকালে আচমকা বেজে উঠল টেলিফোন। ফোন ধরে নিজের বিস্ময়কে কাটাতে পারছিলেন না আর কে। যাকে সকাল বিকেল তুলোধোনা করছেন, সেই মানুষ, দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাকে ফোন করেছেন! নিশ্চয় তাহলে কিছু কড়া কথা শোনাবেন। তিনিও জবাব দেওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত। আরও অবাক করে দিয়ে জওহরলাল বললেন, ‘আজ সকালে আপনার আঁকা আমার কার্টুনটা বড্ড ভাল লেগেছে। আপনার আঁকা আসল ছবিটা কি আমাকে দেওয়া যাবে! আমি ওটা ফ্রেমবন্দি করে নিজের কাছে রাখতে চাই।’
এই সৌজন্য আরকে-কে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছিলেন। শিল্পী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে নিজের আঁকা ছবি পাঠালেও। কার্টুনিস্ট হিসেবে তিনি থেকে গিয়েছিলেন সমান ক্ষুরধার।
তিনি কমন ম্যানের প্রতিনিধি। মুম্বইয়ের ওরলি সি লিঙ্কে তাঁর সৃষ্টি কমন ম্যানের প্রতিকৃতির আদলে তৈরি হয়েছে ভাস্কর্য। সাধারণ মানুষের ব্যস্ত চলাচলের নীরব সাক্ষী, দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গ দিচ্ছে সাধারণ মানুষের দিনযাপন আর চিন্তার।