নিজেদের মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে গিয়েছে কবেই। তবু, এখনও রেজাল্ট বেরোনোর আগে একইভাবে টেনশন হয় তাঁদের। কেউ জানতে পারুক বা না পারুক, প্রতি বছর আরও একবার পরীক্ষা পাশ করে যান তাঁরা। সেই গৃহশিক্ষকদের গল্প বললেন শুভদীপ রায়।
হলে বসে খাতায় কলমে উত্তর লেখেন না বটে। তবে পরীক্ষার দিনই হোক কি রেজাল্ট বেরোনোর দিন, যে কোনও পড়ুয়ার মতোই চিন্তা আর উদ্বেগ ঘিরে থাকে তাঁদেরও। ফল বেরোলে কখনও আনন্দ, কখনও বা হতাশা। ফের নতুন করে প্রস্তুতির পালা। একজন পড়ুয়ার মতোই। তবে পড়ুয়া নন, তাঁদের কাজ পড়ানো। গৃহশিক্ষকতাই তাঁদের পেশা।
মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোলে টিভিতে কাগজে হইহই পড়ে। আর সেই দিনগুলোই গৃহশিক্ষকদের রেড লেটার ডে। সবাই ভালোভাবে পাশ করে যাক এটুকুই কাম্য। এর থেকে বেশি একজন গৃহশিক্ষক আর কী-ই বা চাইতে পারেন!
ভাবতে ভাবতেই সময় গড়ায়। একে একে সবার রেজাল্ট জানা যায়। ফোনও আসে কয়েকজনের। ফোনকলগুলো মুখের হাসি চওড়া করে দেয়। তিন মাসের বাকি থাকা মাইনে একসঙ্গে পেলেও বোধহয় এত আনন্দ হয় না। আসলে, পরীক্ষা না দিয়েও রেজাল্টের টেনশনে যাঁদের ঘুম ওড়ে, তাঁরা গৃহ শিক্ষক। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মতো ভার নেই নামের সঙ্গে। অভিজ্ঞতার ভারেও তেমন পোক্ত নন। কেউ হয়তো অন্য পেশার মানুষ। পড়াতে ভালোবাসেন তাই পড়ান। কারও আবার এটাই পেশা। সেক্ষেত্রে গল্পটা খানিক আলাদা। এঁদের অফিস যাওয়ার তাড়াও নেই। তেমনই ছুটির কোনও দিন নেই। রোদ-ঝড় পেরিয়ে পড়াতে যেতেই হবে। জ্বরে গা পুড়লেও ব্যাচ বন্ধ করা যাবে না। এঁদের কাছে পড়ানোটা নেশার মতো। পয়সার জন্য নয়, এঁরা নিজেদের জন্য পড়ান। জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো অন্য কারও মধ্যে দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা। স্বীকৃতি মিললে ভালো। না হলেও আপত্তি নেই। কারণ ব্যাচের পর ব্যাচ বদলে যাবে। কেউ কেন স্বীকৃতি দিল না, সেই নিয়ে বসলে থাকলে চলবে না। এর মাঝে একজন দুজন এমন আসে, যারা আত্মীয়ের থেকেও আপন হয়ে ওঠে। সে সম্পর্কের সংজ্ঞা কখনও বোন, ভাই, কখনও আবার সন্তানের মতো। সেই একজন দুজন যোগাযোগ রাখে আজীবন। ব্যাচের পর ব্যাচ হাঁ করে তাদের গল্প শোনে।
আসলে, গৃহশিক্ষকের কাজ স্রেফ পড়ানো নয়। তার বাইরেও জীবনের একটা বড় অংশ শিখিয়ে যান তিনি। একসময় মাস্টারমশাইদের বেশ কদর ছিল। রবি ঠাকুরের ছেলেবেলার গল্পেও সেই ছবি ধরা পড়ে। আজকের দিনে সেই সম্মান নেই বললে চলে না। তবে কিছুটা ক্ষীণ হয়েছে বইকি। তাও র্যাঙ্ক করা ছাত্র ছাত্রীদের মুখে এখনও শোনা যায় গৃহ শিক্ষকের কথা। কেউ কেউ নিজের যাবতীয় সাফল্যের ক্রেডিট পছন্দের স্যারকেই দিতে চান। এর থেকে বড় প্রাপ্তি একজন গৃহশিক্ষকের কাছে আর কীই বা হতে পারে! তাই তো যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মোবাইলে ওপারে পৌঁছে গিয়েছেন তাঁরা। অনলাইনে রমরমিয়ে চলছে টিউশন। সেখানে অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রীর মুখটুকুও দেখা যায় না। তাই সই! সবাই শিখছে নতুন কিছু, এটাই অনেক। কীভাবে পড়লে সহজে উত্তর মুখস্থ হবে কিংবা কোন নিয়মে অঙ্কটা নির্ভুল হতে বাধ্য, সেই সবকিছু শিখিয়ে যেতে হবে। করোনার পর থেকেই এটাই অনেকের কাছে স্বাভাবিক। স্যার বাড়িতে আসবেন কিংবা স্যারের বাড়ি যেতে হবে, এমনটা অনেকেরই সিলেবাসের বাইরে। কিন্তু শিক্ষকদের আবেগটা কোথাও গিয়ে একরকম রয়ে গিয়েছে। নিজেদের মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে গিয়েছে কবেই। তবুও, এখনও রেজাল্ট বেরোনোর আগে টেনশন একইভাবে হয় তাঁদেরও। কেউ জানতে পারুক বা না পারুক, প্রতি বছর আরও একবার পরীক্ষা পাশ করে যান তাঁরা।