শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডি-র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থ-ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দুটি আবাসন থেকে উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা। শহর জুড়ে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছেন ইডির আধিকারিকরা। শহরের অলিগলিতে কান পাতলেই এখন শুধু ইডি-র নাম। তা এই ইডি বা ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট’ কীসের বলে এত বলীয়ান। আসুন, শুনে নিই, কেন্দ্রীয় এই এজেন্সিটির গোড়ার কথা।
দুর্নীতি কিংবা আর্থিক কেলেঙ্কারি বা অর্থ পাচার – এই অপরাধগুলির সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিক ভাবে উঠে আসে যে কেন্দ্রীয় সংস্থাটির নাম, সেটি হল ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট। এ রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে বারবার শোনা যাচ্ছে এই কেন্দ্রীয় সংস্থাটির নাম। শুধু এ রাজ্যেই নয়, ন্যাশনাল হেরল্ড থেকে শুরু করে দেশ জুড়ে ঘটে চলা একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলার তদন্ত করছে সংস্থাটি।
আরও শুনুন: রোবট তৈরিতে কাজে লাগছে মৃত মাকড়সা, তাক লাগানো আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের
বেআইনি অর্থ লেনদেনের ও অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত অপরাধগুলির তদন্তের জন্য ১৯৫৬ সালের ১ মে গঠন করা হয়েছিল সংস্থাটি। তখন অবশ্য এর নাম ছিল ‘এনফোর্সমেন্ট ইউনিট’। ১৯৪৭ সালের ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট’ (FERA ’47)-এর অপব্যবহার আটকাতে অর্থমন্ত্রকের ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স’-এর উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ওই বিশেষ শাখা। ১৯৫৭ সালে তার নাম বদলে রাখা হল ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট’। সে সময় ওই সংস্থার প্রধানের দায়িত্ব পান আয়কর দপ্তরের প্রাক্তন প্রধান সঞ্জয় কুমার মিশ্র। কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবের পদমর্যাদার পদ ছিল সেটি। প্রাথমিক ভাবে দিল্লিতে একটি সদর দপ্তর এবং কলকাতা ও তৎকালীন বম্বে অর্থাৎ মুম্বইতে দুটি দপ্তর খোলা হয়েছিল ইডির। ১৯৫৭ সাল নাগাদ মাদ্রাজ তথা এখনকার চেন্নাইয়ে আরও একটি শাখা খোলে ইডি। তার পর গোটা দেশ জুড়ে ক্রমশ শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে গিয়েছে ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট’। পুনে, বেঙ্গালুরু, চণ্ডীগড়, চেন্নাই, কোচি, পানাজি, গুয়াহাটি থেকে শুরু করে বহু জায়গাতেই রয়েছে ইডির আঞ্চলিক অফিস। বর্তমানে মোট ৩৯টি জোনে ভাগ হয়ে কাজ করছে সংস্থাটি।
আরও শুনুন: হারিয়েছেন স্বামীকে, অকালমৃত্যু দুই সন্তানের… শোকের ঝড় পেরিয়ে রাইসিনা হিলসে দ্রৌপদী মুর্মু
এরপর দেশের আইনব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে সংস্থার কাজের ধরন এবং প্রকৃতি। ১৯৬০ সাল নাগাদ ইডির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের হাতে। ১৯৪৭ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টের অনেকখানি সংশোধন ও পরিমার্জন হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ১৯৯৯ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (FEMA) কার্যকর হয় ২০০০ সাল নাগাদ। আর সেই আইনটি বলবৎ হওয়ার পরে অনেকখানি দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় এই সংস্থাটির। আপাতত ইডি যে চারটি আইনে কাজ করে সেগুলি হল, ‘দ্য প্রিভেনশন অব মানি লনডারিং অ্যাক্ট, ২০০২’ (PMLA)। ফৌজদারি এই আইন অনুসারে, বেআইনি অর্থনেতিক লেনদেন ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এবং সেক্ষেত্রে অভিযুক্তর সম্পত্তি আটক করার ক্ষমতা রয়েছে ইডির হাতে। এর পরেই রয়েছে ‘দ্য ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৯৯’ (FEMA)। দেওয়ানি এই আইনটি প্রয়োগ করা হয় বিদেশে টাকা পাচার সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে। ওই আইনের লঙ্ঘনকারীদের মামলার তদন্তভার যায় ইডির হাতে। তিন নম্বরে রয়েছে, ‘দ্য ফিউজিটিভ ইকোনমিক অফেন্ডারস অ্যাক্ট, ২০১৮’ (FEOA)। ভারতে বেআইনি অর্থকেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তরা যখন আইন ফাঁকি দিতে অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়, এই আইনবলে তাঁদের এ দেশের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে ইডি। এবং সবশেষে রয়েছে ‘কনজারভেশন অব ফরেন এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড প্রিভেনশন অব স্মাগলিং অ্যাকটিভিটিস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ (COFEPOSA)। বিদেশে অর্থপাচারে অভিযুক্ত অর্থাৎ দ্য ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-এর লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে এই আইনবলে স্বতপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ করতে পারে ইডি।
আরও শুনুন: নাবালিকা ‘স্ত্রী’-র সঙ্গে যৌনসম্পর্ক ধর্ষণেরই শামিল, রায় দিল্লি হাইকোর্টের
কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারী সংস্থাটির হাতে এমন বেশ কিছু ক্ষমতা রয়েছে যা সিবিআই বা রাজ্য পুলিশের হাতে নেই। প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্টের আওতায় ইডির তদন্তকারী আধিকারিকের সামনে রেকর্ড হওয়া অভিযুক্তের বয়ান আদালতে প্রমাণ হিসেবেই ধার্য হবে। সিবিআই বা রাজ্যপুলিশের ক্ষেত্রে যাকে স্বীকৃতি দেয় না কোর্ট। পাশাপাশি ওই আইনের আওতায় কোনও অপরাধই জামিনযোগ্য নয়। ইডি-র নিজস্ব কোনও লকআপ বা জেল নেই। নেই ভিআইপি অভিযুক্তদের জন্য বিশেষ কোনও সেলের ব্যবস্থাও। ফলে ইডি হেফাজতে ভিআইপি থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই সমান। আর এ সমস্ত ক্ষমতাই আরও মজবুত করেছে ইডির হাত। সম্প্রতি ইডির ক্ষমতায় সিলমোহর দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টও। শীর্ষ আদালতের তরফে বলা হয়েছে, অর্থপাচারের মামলায় গ্রেপ্তার, তল্লাশি এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি রয়েছে ইডির। এমনকী ইডির দায়ের করা অভিযোগপত্র অর্থাৎ ইসিআইআরের কপি পর্যন্ত অভিযুক্তের হাতে দিতে বাধ্য নয় তদন্তকারী সংস্থা। এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। যা ইডিকে আরও শক্তিশালী করে দিয়েছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তবে ইচ্ছেমতো যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, সে-নির্দেশও দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
আর সেই সমস্ত ক্ষমতাবলেই দেশ জুড়ে একের পর এক বেআইনি অর্থসংক্রান্ত মামলার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় এই সংস্থার। নাম জড়িয়েছে বিভিন্ন হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীরও। বর্তমানে কেন্দ্রীয় এই সংস্থাটিকে ডরান না, এমন প্রভাবশালী বোধহয় এ দেশে একজনও নেই।