মানুষের আদালত। সেখানে বিচার হয় ভগবানের। ভক্তের ডাকে সাড়া না দিলে বিচার শুরু হয় ভগবানের। দেওয়া হয় ভুল শোধরানোর সুযোগ। তাতেও কাজ না হলে শাস্তি। কোথায় রয়েছে এমন আদালত? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
আজ তোমার পরীক্ষা ভগবান…
সিনেমার গান। বাস্তবে এমনটা ভেবেও থাকেন অনেকেই। কিন্তু ভগবানের পরীক্ষা নিচ্ছেন, একথা সর্বসমক্ষে বলার সাহস করেন না কেউ। ব্যতিক্রম ছত্তিশগড়ের কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়। তাঁদের কাছে ভগবানের পরীক্ষা নেওয়া বা বিচার করা খুবই সাধারণ ব্যাপার। তার জন্য রয়েছে আলাদা আদালতও।
:আরও শুনুন:
বিচার আর কবে? ৩০ বছর ধরে আদালতে ঝুলে আছে প্রায় ৬২ হাজার মামলা
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। এঁরা প্রতিবছর নিয়ম করে ভগবানের জন্য বিচারসভার আয়োজন করেন। ভগবানের দোষ বলতে, তিনি ভক্তের ডাকে সাড়া দেননি। দোষ প্রমাণ হলে মেলে শাস্তিও। যে দেবতাকে মন্দিরে রেখে নিয়মিত পুজো করা হয়, সেই তাঁকেই শাস্তি দেন ভক্তরা। ছত্তিশগড়ের বস্তার এলাকায় মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। গন্দ, মারিয়া, ভাত্রা, হালবা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ এই অঞ্চলে থাকেন। এমনিতে ছত্তিশগড়ের বাস্তার মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবেই প্রসিদ্ধ। বিভিন্ন ঘটনায় বারবার শিরোনামও দখল করেছে। তবে আরও একটি কারণে বাস্তারের গুরুত্ব রয়েছে। তা হল জনতার আদালত। যে আদালতে বিচার হয় স্বয়ং ভগবানের।
:আরও শুনুন:
প্রতি ১৩ দিনে ১ অভিযুক্তকে হত্যা! অপরাধীর মৃত্যুর দাবিতেই অনড় এই রাজ্য
শিব, দুর্গা, কালির মতো দেবদেবীরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের আরাধ্য নন। নাম আলাদা, পুজোর ধরনও আলাদা। বিগ্রহ তৈরি হয় কাঠ বা বাঁশ দিয়ে। সেইসব বিগ্রহ নিয়েই বছরের নির্দিষ্ট দিনে এক জায়গায় জড়ো হন আদিবাসীরা। বসে জনতার আদালত। অভিযুক্ত ভগবানের বিগ্রহ পেশ করা হয় সেখানে। সাক্ষী হিসেবে থাকে গাছপালা, পশু-পাখি। মূলত মুরগিকেই সাক্ষী হিসেবে নিয়ে আসা হয় এই আদালতে। এরপর একে একে নিজেদের অভিযোগ জানাতে আসেন স্থানীয়রা। কারও সন্তানের অসুখ সারেনি, কেউ ব্যবসায় লোকসান করেছেন, কারও জমিতে ফসল হয়নি। বছরের বিভিন্ন সময়ে এইসব বিপদ পরে ভগবানের কাছেই ছুটেছিলেন। কিন্তু ডাকে সাড়া দেননি ঈশ্বর। আর এটাই তাঁর অপরাধ। জনতার আদালতে প্রথমেই ভগবানকে শোনানো হয়, ঠিক কোন সমস্যায় তিনি সাহায্য করেননি। এরপর দেওয়া হয় ভুল শোধরানোর সুযোগ। তক্ষনি ভক্তের মনের ইচ্ছা পূরণ করলে শাস্তি মাফ। কিন্তু তেমনটা না হলে, শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু ভগবানকে ঠিক কী শাস্তি দেন ভক্তরা?
শুনতে অবাক লাগলেও, শাস্তিরও রয়েছে একাধিক বিধান।প্রচলিত শাস্তি নির্বাসন। কাঠের বিগ্রহ দূরে কোথাও ফেলে দেওয়া হয়। অর্থাৎ মন্দিরে আর পূজিত হবেন না ওই বিগ্রহ। স্রেফ একতরফা বিচার হয় না মোটেও। ভগবানের তরফে উকিল হিসেবে থাকেন গ্রামের মুরুব্বীরা। তাঁরাই ভগবানের দোষের বহর শুনে ঠিক করেন পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। অনেক সময় ভগবানের হয়ে সময় চেয়ে নেন। আবার কখনও সটান শাস্তির কথা বলেন। সবমিলিয়ে প্রতিবছর অদ্ভুত এক লোকাচারের সাক্ষী থাকে এই অঞ্চল। এঁদের কাছে ভগবান আলাদা অনেকটা দূরে থাকা কেউ নন। তাই ভুল করলে তাঁকেও শাস্তি পেতে হবে, সেই ধারণায় বিশ্বাসী এখানকা আদিবাসীরা। অনেকসময় মূল্যবান অলংকার পরানো অবস্থাতেই বিগ্রহ মন্দিরের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। সাধারণত গাছের নীচে অবহেলায় পরে থাকেন সেই দেবতা। কিন্তু কেউ গয়না চুরি করেন না। শাস্তি হিসেবে ওই স্থানে রয়েছেন দেবতা, এমনটাই সকলে বিশ্বাস করেন। আবার ভুল শুধরে ভগবান যদি ভক্তের মনের ইচ্ছা পূরণ করেন তাহলে পুনরায় মন্দিরে ঠাঁই পান। এখানকার প্রসিদ্ধ লোকদেবী ভানগ্রামের থানে, এই আদালত বসে। তাঁকেও হাজির করা হয় আদালতে। কেউ অভিযোগ আনলে সেইমতো চলে বিচার। তাতে শাস্তি হলে মন্দিরে আর ফেরা হয় না দেবীর। স্থানীয়রা অবশ্য এই কাজে পাপের ভয় পান না। বরং নিয়ম মেনে বিচার করলে ভগবানও খুশি হন বলেই তাঁদের বিশ্বাস।