ঠিক যেন একটা গরম কড়া। সারাদিন ধরে জল ফুটছে সেখানে। ধোঁয়ার ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। না, কোনও হেঁসেলের কাহিনি মোটেও শোনাচ্ছি না আপনাদের। বলছি একটা আশ্চর্য সুন্দর প্রস্রবণের গল্প। বিশ্বের সব চেয়ে বড় উষ্ণ প্রস্রবণ সেটি। জানেন কোথায় আছে এই ফ্রাইং প্যান লেক? আসুন, শুনে নিই।
এ-ও যেন এক পৃথিবীর আশ্চর্য। মাটির বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে ফুটন্ত জল। সেই জলেই তৈরি হয়েছে বিশাল একটা হ্রদ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, ঠিক যেন একটা কড়া। তার ভিতরে অনর্গল ফুটে চলেছে জল। মাটির নিচে কে যেন একটা জ্বালিয়ে রেখেছে অদৃশ্য আগুন। সেই আগুনেই টগবগিয়ে ফুটছে হ্রদের জল। উঠে আসছে ধোঁয়া ।
তাই টলটলে হ্রদ দেখে পা ডোবাতে ইচ্ছা হলেও সে ইচ্ছাকে কষেবেঁধে রাখা ছাড়া কোনও উপায় নেই। কারণ এই হ্রদের জলের তাপমাত্রা সবসময়েই থাকে ৪৫ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। ফলে এই জল ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত। পৃথিবীর বৃহত্তম উষ্ণ প্রস্রবণ নাকি এই ফ্রাইং প্যান লেক।
নিউজিল্যান্ডের রটোরুয়ার ওয়াইমাঙ্গু ভলক্যানিক রিফ্ট ভ্যালিতে রয়েছে এই হ্রদ। প্রায় ৩৮ হাজার বর্গ মিটার এলাকা জোড়া ওই হ্রদ প্রায় ৬ মিটার পর্যন্ত গভীর। তবে তার ভিতরে রয়েছে বেশ কিছু ভেন্টস, যা ২০ মিটার পর্যন্ত গভীর হতে পারে। এই ফ্রাইং প্যান লেক কিন্তু বেশ বিপজ্জনকও। না, শুধু উত্তপ্ত জলের জন্য়ই নয়। নানা ধরনের অ্যাসিড প্রবাহিত হচ্ছে হ্রদের গভীরে। যার জন্যই অনবরত ফুটে জলে ওই হ্রদের জল। জলের পিএইচ মাত্রা এখানে ৩.৫। মানে ব্যবহারের পক্ষে বেশ অ্যাসিডিক এই জল।
আরও শুনুন: নড়েচড়ে, আকারে বাড়ে, করে বংশবিস্তারও! জানেন কোথায় মেলে এমন ‘জীবন্ত’ পাথর?
আসলে এই লেকের জন্মবৃত্তান্তের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ফুটন্ত কড়াইয়ের আসল রহস্য। ১৮৮৬ সালে নিউজিল্যান্ডে জেগে উঠেছিল মাউন্ট তারাওয়ারা আগ্নেয়গিরি। এখনও পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় অগ্নুৎপাতের ঘটনা ছিল এটিই। যার জেরে মৃত্যু হয়েছিল কয়েকশো মানুষের। ওই অগ্নুৎপাতের ফলেই তৈরি হয়েছিল বিশালাকার এক জ্বালামুখ বা গর্তের। তার পরে তা ওভাবেই পড়েছিল দীর্ঘ দিন। ১৩০ বছর পর সেই মুখ থেকে হঠাৎই জেগে উঠেছিল একটি উষ্ণ প্রস্রবণ, যার জল এখনও ফুটে চলেছে সমান তালে।
উপর থেকে ওই প্রস্রবনের দিকে তাকালে মনে হয়, এখনও হ্রদের থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। মনে করা হয়, ওই হ্রদের নিচে এখনও রয়ে গিয়েছে উত্তপ্ত ম্যাগমা ও বিভিন্ন রকম গ্যাস। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, আজও ওই হ্রদের থেকে সমান তালে বেরিয়ে আসছে বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে হ্রদের পাশে তৈরি হয়েছে একটি প্রাকৃতিক চিমনির মতো জায়গা, যেখান থেকে অনবরত বেরোতে থাকে ওই গ্যাস।
আরও শুনুন: তেরো মাসে বছর, তাই এই দেশে এখন চলছে ২০১৩ সাল, জানেন এই দেশের কথা?
হ্রদের আশপাশে তেমন কোনও গাছপালার দেখা মিলবে না এখানে। তবে নীল-সবুজ শ্যাওলা গজায় হ্রদের চারধারে। এই শ্যাওলার জন্যই হালকা কমলা রং ধারণ করেছে হ্রদের জল। শুধুমাত্র থার্মোফিল জাতীয় এক ধরনের ব্যাকটিরিয়া এমন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় বাঁচতে পারে। এই হ্রদের জলেও মিলবে আর্কিয়া নামে ওই অনুজীব। ওই হ্রদে যেটুকু জীবন বেঁচে থাকতে পেরেছে, মনে করা হয় সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই পৃথিবীতে রয়েছে তারা। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক আশ্চর্য উত্তপ্ত কড়ার মতো দেখতে এই হ্রদ। তাই যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, এমন আশ্চর্য সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকেরা প্রায়শই ভিড় জমান নিউজিল্যান্ডের রটোরুয়ায়। আর হবে না-ই বা কেন! এত বড় উষ্ণ প্রস্রবন যে পৃথিবীতে আর দুটো নেই।