সমাজের কোনও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি যদি অত্যন্ত সমস্যাজনক কোনও মন্তব্যও করেন, হয়তো দেখা যায়, তিনি তা সত্ত্বেও নিশ্চিন্তে পার পেয়ে গেলেন। অথচ অন্যদিকে, অতি সাধারণ কোনও মানুষের বলা কথাকে সামনে রেখে হয়তো রীতিমত আক্রমণ হানা হল তার উপর। ফলে বাকস্বাধীনতা নামের লাইসেন্সটির মেয়াদ যে ক্ষমতাই নিশ্চিত করে দেয়, সে নিয়ে আর সন্দেহ থাকে না।
বাক্স্বাধীনতা (Freedom of speech) যেন লাইসেন্স – কোন অবস্থায় কতটুকু কথা বলা যায় আর কোনখানে গিয়ে দাঁড়ি টানতে লাগে, তা নির্ধারণ করার অধিকার। যেখানে যা ইচ্ছে হয়, তাই কি বলতে পারে মানুষ? নাকি মুখনিঃসৃত প্রতিটা কথারই হিসেব দিয়ে যেতে হয় তাকে? মানুষ যাতে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারে, সে জায়গা নিশ্চিত করে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। তাই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় একদিকে যেমন পছন্দের সেলিব্রিটিকে শুভেচ্ছা জানাতে পারে মানুষ, অন্যদিকে তেমনই মন খুলে নিন্দে করতে পারে। অনেক সময়েই সোশ্যাল মিডিয়ার ঢালখানা সামনে ধরে মানুষ যা কিছু বলে থাকে, সামনাসামনি দাঁড়িয়ে হয়তো তার অর্ধেকও বলতে পারবে না সে। কেন দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাক্স্বাধীনতার (Freedom of speech) সংজ্ঞা? সে নিয়ে যত আলোচনাই করা যাক না কেন, তল মিলবে না কিছুতেই।
সহজ ভাষায় বোঝার চেষ্টা করা যাক বরং। ঘটনা নম্বর এক। ধরা যাক, একজন মানুষ ঢিল ছুড়ে কাচ ভেঙে দিয়েছে অন্য একজনের বাড়ির। দ্বিতীয়জন সেই নিয়ে রাগারাগি করল, চিৎকার করল। কারণ বড়রকম ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তার, আর তাই সে রাগ প্রকাশ করতেই পারে। ঘটনা এখানেই শেষ। আবার অন্য একটি ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেল যে, সবই এক হল। কিন্তু যেই না ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজের হকের কথা বলতে গেল, অমনি আশেপাশের লোক মিলে চড়াও হল তার ওপর। তার বলা প্রতিটা কথার চুলচেরা বিচার করে তাকেই কাঠগড়ায় তুলল সবাই মিলে। কেন? কারণ ঢিল ছুড়েছে যে, সে মানুষ অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, কোনও মানুষ কতখানি কথা বলার অধিকার পাবে, তা নিশ্চিত করবে তার সামাজিক অবস্থানটি। সমাজের কোনও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি যদি অত্যন্ত সমস্যাজনক কোনও মন্তব্যও করেন, হয়তো দেখা যায়, তিনি তা সত্ত্বেও নিশ্চিন্তে পার পেয়ে গেলেন। অথচ অন্যদিকে, অতি সাধারণ কোনও মানুষের বলা কথাকে সামনে রেখে হয়তো রীতিমত আক্রমণ হানা হল তার উপর। অর্থাৎ, বাক্স্বাধীনতা (Freedom of speech) নামের লাইসেন্সটির মেয়াদ যে ক্ষমতাই নিশ্চিত করে দেয়, সে নিয়ে আর সন্দেহ থাকে না।
এই সমস্যা নতুন নয়, তবে পহেলগাঁও হামলার পর যেন উথলে উঠেছে নতুন করেই। বলা বাহুল্য, ভারতের অন্তর্বর্তী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে উসকে দিতেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল এই হামলার। আর বিদেশসচীব তাঁর বক্তব্যে এর সফলতাকে খারিজ করে দিলেও, বাস্তবে যে জনগণের মধ্যে সত্যি করেই ধর্মীয় বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তার সাক্ষী সকলেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিম বিদ্বেষ উগড়ে দিয়েছেন বহু মানুষ। এমনকি ভারত-পাক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার বিষয়টি যখন জনসাধারণের উদ্দেশে জানান বিদেশসচীব বিক্রম মিশ্রী, তখন অদ্ভুত ভাবেই রোশের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। এই সিদ্ধান্তে তাঁর ভূমিকা যত সামান্যই থেকে থাকুক না কেন, জনসাধারণ একপ্রকার চড়াও হয় তাঁর উপর। এমন কাজ বাক্স্বাধীনতার (Freedom of speech) অপপ্রয়োগ ছাড়া আর কীই বা বলা চলে?
একই মুদ্রার অবশ্য অন্য পিঠও রয়ে যায়। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অন্যতম কাণ্ডারি সোফিয়া কুরেশির প্রশংসা করতে গিয়ে মধ্যপ্রদেশের এমপি-র বক্তৃতায় প্রকাশ পেয়ে যায় চাপা ইসলামোফোবিয়া। সেক্ষেত্রে এ কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, অন্য সময় হলে হয়তো তাঁর বলা কথাটির উপর তেমনভাবে নজর যেত না কারও। কিন্তু নেটদুনিয়ার তীক্ষ্ণ নজরের ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে, পার পাননি তিনি। বরং বলা কথার দায় নিতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করল যা, তা জনসাধারণের বাক্স্বাধীনতাই (Freedom of speech) তো!
আর তাই ঘুরে ফিরে ক্ষমতার সংজ্ঞাতেই এসে থেমে যেতে হয় আবারও। শাসক যে-ই হোক না কেন, জনগণের সম্মিলিত ক্ষমতা চাইলে বাকস্বাধীনতার পরিধি নিজেরাই নিশ্চিত করতে পারে। যদিও, সে স্বাধীনতার প্রয়োগ মানুষ ভালো কাজে করবে না খারাপ কাজে, সে সিদ্ধান্ত তারই হাতে থাকে। তবে এ কথা বললে ভুল হয় না যে, সজ্ঞানে বাক্স্বাধীনতার (Freedom of speech) অপপ্রয়োগ করা হয় যদি, তবে তার বিচার চাওয়ার ক্ষমতাও বাকস্বাধীনতারই রয়েছে।