একই খাবার। একই সংস্থার তৈরি। অথচ প্রথম বিশ্বের দেশে তার যা গুণমান, তৃতীয় বিশ্বের দেশে সেই স্বাস্থ্যগুণ কমে যাচ্ছে অনেকগুণ। বেশি লাভের উদ্দেশ্যে মিশে যাচ্ছে বেশি ভেজাল। সেই বিষাক্ত খাবারই জুটছে ভারতের ভাগ্যেও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কম আয়ের দেশ, তাই কম আয়ু পেলেই বা ক্ষতি কী! পুঁজির হিসেব বোধহয় তেমনটাই ভাবে। তাই দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জনপ্রিয় খাদ্য পানীয় প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে যতটা পুষ্টিকর, তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশে তার চেয়ে অনেক কম। একই সংস্থার তৈরি পণ্য হলে কী হবে, তৃতীয় বিশ্বের জন্য তার গুণমান আলাদা। তাতে ভেজাল অনেক বেশি। আর নামী সংস্থার মোড়কে সেই ক্ষতিকারক খাবারই এখানে বিকোচ্ছে রমরমিয়ে। ভারত যতই চাঁদে পৌঁছে যাক আর জি-২০ সামিটের আয়োজক হয়ে উঠুক, পুঁজির সেই গরিব দেশের তালিকায় এ দেশও সগৌরবে বর্তমান। অ্যাক্সেস টু নিউট্রিশন ইনিশিয়েটিভ নামে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, এখানেও পেপসিকো, ইউনিলিভার, ডানোন-এর মতো তাবড় আন্তর্জাতিক ফুড জায়ান্টরা যে পণ্য বিক্রি করছে, তা ওই তৃতীয় বিশ্বের জন্য নির্দিষ্ট খারাপ খাবারই। নানারকম নামীদামি চিপস, সফট ড্রিঙ্ক, জুস, রেডি-টু-ইট সুপ বা অন্যান্য খাবার, নানা সংস্থার আইসক্রিম- সবকিছুই ওই কম গুণমান নিয়ে চলছে। যা না বুঝেই হুড়মুড়িয়ে কিনে চলেছি আমরা। উপরন্তু বিজ্ঞাপনী মোহে এসবের চাহিদা দিনে দিনে আরও বাড়ছে বই কমছে না।
আরও শুনুন:
বাঙালির হাল-খাতা: স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়েই পাত বাড়ে বাঙালি
বিজ্ঞাপন কী বলে? বলে, আরও এনার্জি পাওয়ার জন্য এইসব পানীয় না খেয়ে কোনও উপায় নেই। তা খেলে পঙ্গুও নাকি গিরি লঙ্ঘন করে। প্রেম ভাঙার দুঃখে গোটা দুনিয়াটাই বিস্বাদ লাগছে? চিন্তা নেই, জিভে আর জীবনে স্বাদ ফিরিয়ে দিতে হাজির কোনও বিশেষ প্যাকেজড খাবার। বিজ্ঞাপনের চটক এমনই এক মাপকাঠি তৈরি করে দিয়েছে যে, এসব খেতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। শুধু শৌখিন খাবারই নয়, হেলথ ড্রিংক বা ফুড সাপ্লিমেন্টের ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। যা কিছু অতিরিক্ত দামি, অতিরিক্ত চকচকে, সেইসব বিজ্ঞাপনী মায়াই হয়ে উঠেছে পুষ্টির আরেক নাম।
অথচ সম্প্রতিই বোর্নভিটা-সহ একই ধরনের একাধিক পানীয়ের ‘হেলথ ড্রিংক’ তকমা কেড়েছে কেন্দ্র। আরও বড় কথা হল, এই সব পানীয় নিজেদের সঙ্গে ‘হেলথ ড্রিংক’-এর তকমা ঝুলিয়ে রাখলে কী হবে, ২০০৬-র খাদ্য সুরক্ষা বিধিতে হেলথ ড্রিংক বলে কোনও শ্রেণির উল্লেখই নেই। উপরন্তু ‘ন্যাশনাল কমিশন অফ প্রোটেকশন ফর চাইল্ড রাইটস’-এর তদন্ত জানাচ্ছে, এই সব পানীয়তেই রয়েছে অতিরিক্ত মাত্রায় চিনি, যা কোনও পরিস্থিতিতেই ‘হেলদি’ নয়। একই দোষে দুষ্ট সেরেল্যাকও। ওবেসিটি-সহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের জন্য শিশুদের খাবার নিয়ে যে আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা রয়েছে, প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে সেই নিয়ম মেনেই শিশুখাদ্য বানায় নেসলে। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে যে সেরেল্যাক পাওয়া যায়, তাতেই মেশানো হয় বাড়তি চিনি। একইভাবে প্রচুর চিনি থাকে এনার্জি ড্রিংকেও। চটজলদি এনার্জি বাড়ানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত চিনি অর্থাৎ গ্লুকোজে ঠাসা হচ্ছে এইসব খাদ্য পানীয়। তৃতীয় বিশ্বটাই যেখানে পুঁজির এত বড় বাজার, সেখানে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের খাদ্য আর খাদ্যসুরক্ষাও তো আদতে বাজারের পণ্যই। তাই নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত দেশে রপ্তানি হচ্ছে এমন খাবার, যা গুণমানের পরীক্ষায় উতরোবে না, কিন্তু কম খরচে তৈরি এইসব খাদ্য পানীয় সংস্থাকে এনে দেবে বিপুল লাভ। এই ক্রেতা দেশগুলির তালিকায় রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, ঘানা, ফিলিপাইনস, তানজানিয়া। যদি ৫-এর মাপকাঠিতে ধরা হয়, সেখানে কোনও খাবার বা পানীয় সাড়ে তিন নম্বর পেলে ধরা যায় তার গুণমান ভালোই, তা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু এইসব দেশে ওই খাবারগুলি গড়ে ১.৮ নম্বর পেয়েছে। অথচ সেই একই খাবার নিজের মান বাড়িয়ে গড়ে ২.৩ নম্বরে পৌঁছচ্ছে, উচ্চবিত্ত দেশে ঢোকার ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য।
লোভের কাছে মানুষের প্রাণও যে পণ্যই, সে কথাই আরও একবার বোঝাল এই রিপোর্ট। কিন্তু আমাদের চোখ খুলবে কবে, সেটাই প্রশ্ন।