কোনও একটি অনুষ্ঠান ঘিরে তুঙ্গে উন্মাদনা। নেটদুনিয়া জুড়ে সে উন্মাদনার ঢেউ। সে ঢেউয়ে গা ভাসানোর সাধ বা সাধ্য যদি নাও থাকে, তবু এড়িয়ে যাওয়ার জো নেই। সমাজ কি মেনে নেবে, এই ভয়ের স্রোতে শামিল হওয়ার ট্রেন্ড। আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় একা হওয়ার সেই ভয়কে সম্বল করেই ভয় তাড়ানোর উপায় বিকোচ্ছে, সেই সোশ্যাল মিডিয়াতেই।
সেই কোন সুদূর থেকে শো করতে ভারতে এসে পড়লেন ব্রায়ান অ্যাডামস। সেই শো দেখতে ভিড়ে ভিড়ে ভিড়াক্কার। কিংবা ধরুন, ভিনদেশ না হোক ভিনরাজ্য থেকে দিলজিত দোসাঞ্জও এসে পড়েছেন। সেখানেও ভিড়ে ঠাসা শো। সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়াল জুড়ে কেবল শো-এর ছবি আর ভিডিও। দেখলেন গোটা ফ্রেন্ডলিস্টটাই বোধহয় সেখানে চেক-ইন করে ফেলেছে। কেবল আপনি বাদ! অমনি মনে হল, এ সমাজ কি আদৌ আপনাকে মেনে নেবে? নাহ, আর সে ভয় পেয়ে লাভ নেই। কেন-না আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় একা হওয়ার সেই ভয়কে সম্বল করেই ভয় তাড়ানোর উপায় বিকোচ্ছে, সেই সোশ্যাল মিডিয়াতেই। অন্যরা যেমন শো-তে হাজির হয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, সেখানে না গিয়েও এবার স্ট্যাটাস দেওয়ার সুযোগ আপনার হাতের মুঠোয়। ঠিক স্ট্যাটাস নয়, বলা ভালো উপস্থিতির আরও জোরালো শিলমোহর। অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে আপনাকে ট্যাগ করে দেখানো হবে যে, আপনিও হাজির ছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। স্রেফ ফেলো কড়ি মাখো তেল-এর হিসেব। টাকার বিনিময়েই এখন হাজিরা কিনতে পারবেন আপনি, সে কোনও অনুষ্ঠান, কনসার্ট, শো কিংবা নামী ক্যাফে-রেস্তরাঁ যেখানেই চান।
সাম্প্রতিক কালে বারেবারেই দেখা গিয়েছে, কোনও একটি অনুষ্ঠান ঘিরে তুঙ্গে উন্মাদনা। নেটদুনিয়া জুড়ে সে উন্মাদনার ঢেউ। আর সেই ঢেউ গায়ে মেখে নিয়ে অনেকেই ভাবছেন, এই অনুষ্ঠানে না গেলে তো মুখ দেখানো ভার! নেটদুনিয়ায় যেহেতু মুখই সর্বস্ব, দেখতে-পাওয়া মুখের আড়ালে থাকা ভেতরের মানুষটাকে কেউই চেনে না, ফলে সে মুখের মুখরক্ষার দায়ও অনেকখানি। আর তাই সাধ থাক বা না থাক, এমনকি সাধ্যও থাক বা নাই থাক, অন্য সব মুখের উপর যে আলো এসে পড়ছে তা মেখে নিতেই হয় সে মুখে। যাতে সব মুখকেই একরকম দেখায়। কেন-না আলাদা হওয়ার দায়ও যে অনেকখানি। স্রোত থেকে আলাদা হওয়ার এই ভয়কেই নেটদুনিয়া চেনে ‘ফোমো’ বলে। অর্থাৎ কিনা, ফিয়ার অফ মিসিং আউট। যে সোশ্যাল মিডিয়া সারাক্ষণ লাউডস্পিকার নিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘আমায় দ্যাখো’, সেখানে আমায় কেউ দেখতে পাচ্ছে না এটাই ভয় ধরাতে পারে। আর সেই ভয়ের তাগিদেই মানুষ নিজের সাধ আর সাধ্য দুইকেই ছাপিয়ে যায় বারবার। আর মানুষের সেই ভয়কেই এখন পণ্য করছে সোশ্যাল মিডিয়াও। সেই ভয়কে পুঁজি করেই ওই সকলের ঢেউয়ে ভেসে থাকার টিকিট বিক্রি করছে। সহজ কথায়, সকলে যে অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, সেখানে যদি না যেতে পারেন, তবে সেখানে ছিলেন বলে নকল ফ্লেক্স কিনে নিতে পারেন সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদেই।
এই সোশ্যাল মিডিয়া ফ্লেক্স, অর্থাৎ কোথাও খেতে গিয়ে বা ঘুরতে গিয়ে বা অনুষ্ঠানে গিয়ে সেই উপস্থিতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করার প্রবণতা কিন্তু ছিলই। তবে এতদিন তা ছিল স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়ার প্রবণতা হিসেবেই। আর এখন সোশ্যাল মিডিয়াই তাকে পণ্য করছে। সেখান থেকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ‘গেট ইয়োর ফ্লেক্স’ নামের ব্যবসা। আপনি কোন অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে চান, বা কোন রেস্তরাঁয় খেতে যেতে চান, বলার অপেক্ষা কেবল। ওদিকে হাজির নকল অ্যাকাউন্ট, কোনও সুন্দরী নারী বা পুরুষের ছবি নিয়ে। সেই প্রোফাইল থেকে ওই নির্ধারিত জায়গায় চেক-ইনের পোস্টে আপনাকে ট্যাগ করে দেওয়া হবে, নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে। পুরোটাই নকল, তবে সেই বানানো তকমায় সোশ্যাল মিডিয়াতে তো মানরক্ষা হবে!
সোশ্যাল মিডিয়াতে মানরক্ষার দায়ে এমনিতেই নিজেদের নানাভাবে সাজিয়ে তুলি আমরা। যা নই, যেমনটা নই, তেমন করে নিজেদের হাজির করি- ফোমোর কারণে। নিজেদের সেখানে আমরা যতটা মেলে ধরি, মনের দরজা খুলে দেওয়ার জায়গা সেখানে ততটাই কম। এই নয়া ট্রেন্ড আসলে আরও একটু একলা করল আমাদের। একসময় কনসার্ট-থিয়েটার-ব্যান্ডের অনুষ্ঠান ছিল সমমনস্ক মানুষদের একসঙ্গে উপভোগের আসর। ইদানীং কালে সাধ-সাধ্য জলাঞ্জলি দিয়ে বাকিদের নকল করে অনুষ্ঠানে যাওয়ার তোড়ে সেই নিজস্ব উপভোগে ঘাটতি পড়েছে অনেকটাই। আর বাড়ির বাইরেও পা না রেখে স্রেফ টাকার বিনিময়ে হাজিরা কেনার এই নয়া সুযোগ তাতে যোগ করল নয়া মাত্রা। যেখানে সামাজিকতা থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হল মানুষ। স্রোত থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয় কাটাতে গিয়ে বাস্তবে যে একলাই হয়ে পড়তে হচ্ছে, সে কথা কি বুঝছি আমরা?