মরুভূমি মানেই তো শুধু ধু ধু বালি, রুক্ষ আর শুষ্কতা, জলের চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু এই মরুভূমি তার ব্যতিক্রম। সারা বছর এই মরুভূমি বাকি মরুভূমিদের মতোই, শুধু বালি আর বালি। তবে বর্ষা এলেই পাল্টে যেতে থাকে এই মরুরাজ্য। কোথা কোথা থেকে যেন জল ঢুকতে থাকে বালির বুকে। তৈরি হতে থাকে উপহ্রদ। তখন তাকে দেখলে মরুভূমি বলে চিনতে ভুল হয়। একই মরুভূমির এমন রূপ কিন্তু অবাক করার মতোই। কোথায় আছে এমন টু ইন ওয়ান মরুভূমি? শুনে নিন।
একই অঙ্গে তার দুই রূপ। সারা বছর যে কোনও মরুভূমির মতোই শুকনো, খটখটে এই মরুভূমি। কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই। সাদা বালি রোদ্দুর লেগে ঝিকমিক করে। গ্রীষ্মকালে বালির তাপমাত্রা পৌঁছে যায় কখনও কখনও ৭০ থেকে ৭৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্তও।
তবে বর্ষা না আসতে আসতে সেই শুকনো খটখটে মরুভূমির বুক ভরতে থাকে জলে। তৈরি হয় একের পর এক উপহ্রদ। বালির নীচের পাথরের আস্তরণ সেই জল ধরে রাখতে সাহায্য করে। নানা পাখি উড়ে আসে উপহ্রদের বুকে। গরম থাকতে থাকতেই আমাজনের জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পিনিঙ্গা কচ্ছপ। যাতে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তারা পৌঁছে যায় সেসব জলভর্তি উপহ্রদের কাছে। কারণ সেখানে একবার পৌঁছতে পারলে খাবারের অভাব থাকবে না বেশ কিছুদিন।
আরও শুনুন: ঘন বনাঞ্চল থেকে রুক্ষ মরুভূমি, কীভাবে বদলে গেল সাহারা?
ব্রাজিলের মারানহোতে লেনসয়েস মারেনহেনসিস জাতীয় উদ্যান। জাতীয় উদ্যান হলেও এ জায়গা জুড়ে শুধুই বালি। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বে অতলান্তিক মহাসাগরের উপকূলে রয়েছে এই মরুঅঞ্চল। প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে এই মরুভূমি। আসলে ব্যাপারটা কী জানেন, এককালে সেখানে ছিল জঙ্গলই। তবে বছরের পর বছর ধরে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে বয়ে আনা বালি জমে জমে সেই জঙ্গল যেন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন সেখানে প্রাণহীন মরুভূমি শুধু।
তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই সময়টায় আমূল বদলে যায় সবটা। এই সময়টায় লেনসয়েসে গেলে দেখবেন, সাদা বালির মধ্যে মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে কয়েক হাজার উপহ্রদ। সেই টারকয়েজ নীল উপহ্রদের রূপ আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য।
ভাবছেন নিশ্চয়ই মরুভূমির মাঝে হঠাৎ করে কোথা থেকে চলে আসে এই জল! পর্যটকদেরও বিস্মিত করে দেয় ব্যাপারটি। অতলান্তিক সমুদ্র থেকে তো জল কিছুটা আসে বটেই, আর বাকিটা আসে বৃষ্টি থেকে। প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে এখানে জমতে থাকে জল। তখন অবশ্য তাকে দেখলে জলাভূমি বলেই ভুল হবে। সাদা বালির ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয় ওয়েসিস। বর্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বালির বুকে উপহ্রদগুলির আকারও বাড়তে থাকে। প্রচুর মাছ এসে ঘর বাঁধে সেই জলে। মরুভূমির আশপাশে থাকা অন্যপ্রাণীরাও জলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে মরুভূমির কাছে তাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে।
সাধারণ ভাবে গ্রীষ্মের বালির নীচের স্তরে লুকিয়ে থাকে চার চোখ বিশিষ্ট ব্যাঙ। যাকে কলোম্বিয়ান ব্যাঙও বলে থাকেন অনেকে। বর্ষা আসতে না আসতে মাটির তলার আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে তারা। রুক্ষ মরুভূমি যে তখন টলটলে জলে ভরা। এই সময়টায় তাই প্রজননে মন দেয় এরা। শুধু ব্যাঙই নয়, হ্রদে জড়ো হতে থাকা অন্যান্য প্রাণীরাও এ সময়টাকে বেছে নেয় বংশবিস্তারের জন্য। সারা বছর যে মরু অঞ্চলে প্রাণের সাড়া পর্যন্ত পাওয়া যায় না, তা এই সময় ভরে ওঠে জীবনের সমারোহে।
আরও শুনুন: দিনরাত টগবগ করে জল ফুটছে, জানেন কোথায় আছে এমন অদ্ভুত হ্রদ?
কিন্তু অক্টোবর আসতে না আসতেই বদলাতে থাকে আবহাওয়া। রোদের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকোতে শুরু করে সমস্ত জল। আর এক সময় তা ফিরে যায় ফের পুরনো অবস্থায়। তখন চারদিকে শুধুই বালি আর বালি। আর পাঁচটা মরুভূমির মতোই রুক্ষ, শুষ্ক, খটখটে রূপ ধারণ করে এই লেনসয়েস মারেনহেনসিস জাতীয় উদ্যান। তখন শুধুই অপেক্ষা। আরও একটা বর্ষার, আবার কখন বৃষ্টির জল বুকে ভরে বদলে যাবে গোটা একটা মরুভূমি।
বর্ষার ওই রূপ দেখতে প্রায়শই পর্যটকেরা ছুটে যান ব্রাজিলের ওই মরুভূমিতে। জিপ কিংবা হেলিকপ্টারে করে চলে সাফারি। বর্ষার সময় আকাশ থেকে ওই মরুহ্রদ দেখার মজাটাই নাকি আলাদা। তাই এই জায়গার কদর ক্রমশই বাড়ছে পর্যটকদের কাছে। মখমলে নীল জলের উপহ্রদ আর মধ্যে মধ্যে সাদা বালির সীমানা, সেই দৃশ্য বোধহয় স্বপ্নের থেকে কম কিছু নয়।