কেউ চিনবে না। কেউ বুঝবে না। অথচ নিজের কাজ হাসিল করে বেরিয়ে আসবে গুপ্তচর। ধরা পড়লেই সব শেষ। কিন্তু সেই অবকাশ সচরাচর আসে না। কারণ শত্রুর চোখে ধুলো দিতে এরা ওস্তাদ। এক্ষেত্রে পুরুষের চাইতে নারীরা পাল্লাভারি। ইতিহাস কী জানাচ্ছে মহিলা চরদের সম্পর্কে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ব্যাপারটা পিছন থেকে ছুরি মারার মতো! যুদ্ধের নিয়মে এর উল্লেখ নেই। নীতির বিরুদ্ধে কাজ বলাই যায়। তবু যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। এখনও বিশ্বের প্রায় প্রতিটা দেশে অন্য দেশের গুপ্তচররা (Female Spy) গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। সময় সুযোগ মতো পাচার হতে থাকে ভেতরকার খবর। বিশেষ করে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যদি তেমন ভালো না হয়।
ভারত-পাক সংঘাতের আবহে নতুন করে এই গুপ্তচর প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। সৌজন্যে জ্যোতি মালহোত্রা। জানা যাচ্ছে, এই মহিলা ভারতে পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করত। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেরিয়ে গোপন তথ্য পাচার করত। কাশ্মীর হামলার নেপথ্যেও জ্যোতির ভূমিকা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। এই আবহে ধরা পড়েছে আরও অনেক গুপ্তচর (Female Spy)। যারা নানা সময় নানা ভাবে পাকিস্তানের চরবৃত্তি করেছে। বিষয়টা যে খুব অস্বাভাবিক তা নয়। দেশের প্রয়োজনেই জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নানা মিশনে শামিল হয় এই গুপ্তচরেরা। তবে, তাদের কাজের ধরনটা আলাদা। যেহেতু গোড়াতেই গুপ্ত কথাটা আছে, তাই সবার আগে শিখে ফেলতে হয় নিজেকে লুকিয়ে ফেলার কৌশল। আর সেক্ষেত্রে হাতিয়ারও হয় অন্যরকম। প্রথাগত গুলি-বারুদ নিয়ে লড়াই নয়। বেশিরভাগ সময়েই তাদের লড়তে হয় মানুষের আদিম প্রবৃত্তিকে হাতিয়ার করে। এক্ষেত্রে যৌনতাও হয়ে ওঠে শত্রুকে ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্র। গুপ্তচরদের যে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাতে যৌনতার কলাকৌশল শেখানো হয়। ইতিহাস সাক্ষী আছে রূপের মোহে ভুলিয়ে গোপনে নিজের কাজ হাসিল করেছেন এমন মহিলা গুপ্তচর সংখ্যায় অনেক।
প্রথমেই যার নাম বলতে হয় তিনি মাতা হারি। যৌনতাকে হাতিয়ার করেই দিনের পর দিন চালিয়ে গিয়েছিলেন গুপ্তচরবৃত্তি (Female Spy)। একের পর এক পুরুষের সঙ্গযাপন, নিজের প্রয়োজনে তাদের কাজ লাগানো, সবই রূপের মায়ায় হাসিল করতেন মাতা হারি। চরবৃত্তির ইতিহাসে তাঁর নাম বড় হরফে লেখা আছে বইকি। গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আটকও হন মাতা হারি। এক্ষেত্রেও সেই রূপ আর যৌবনকে কাজে লাগিয়ে মুক্ত হন। শোনা যায়, এক গোয়েন্দাকর্তাকে যৌনতার টোপ দিয়ে ভুলিয়ে ছিলেন মাতা হারি। শেষজীবনটা অবশ্য খুব একটা সুখের হয়নি, মরতে হয়েছিল গুলির আঘাতে। তবে ইতিহাস তাঁকে ভোলেনি আজও। মাতা হারির মতো দুঃসাহসিক জীবন যে আর কেউ কাটাননি এমনটা বলা যায় না। তাই মহিলা চরের তালিকায় পরের নাম হিসেবে বলতে হয় নান্সি ওয়েকের কথা। তাঁর গল্পে অবশ্য যৌনতার কথা নেই, বরং রয়েছে মগজাস্ত্রের কথা। এতটাই বুদ্ধি ধরতেন যে শত্রুর হাতে প্রায় ধরা দেননি বলা চলে। বিশ্বযুদ্ধের আবহে নাৎসিদের কাছে ত্রাস হইয়ে উঠেছিলেন নান্সি। ৫০০ কিমি সাইকেলে পাড়ি দিয়ে শত্রুর চোখে ধুলো দিয়েছিলেন একবার। তাঁর মাথার দাম ঠিক করা হয়েছিল ৫০ লক্ষ। তাও ফ্রান্সের মুদ্রার হিসেবে। তাতেও লাভের লাভ হয়নি। ইনি অবশ্য নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন পরবর্তীকালে। এমন বুদ্ধিমান মহিলা চর তাঁর সময় আর কেউ ছিল না বললেই চলে।
এরপর বলতে হয় ভার্জিনিয়া হল-এর কথা। ইনিও নাৎসি দলের ত্রাস ছিলেন। তবে এর নামটা আলাদা করে বলার বিশেষ কারণ রয়েছে। ভার্জানিয়ার একটা পা ছিল কাঠের। দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে ওই নকল পা নিয়েই যা কিছু করতে হত তাঁকে। এমন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দুর্ধর্ষ চর হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন ভার্জিনিয়া। শোনা যায়, একবার ধরা পড়া থেকে বাঁচতে কাঠের পা নিয়েই পাহাড় চড়েছিলেন ভার্জিনিয়া। তাই ইতিহাসে তাঁর নামটিও বেশ চর্চিত। পরের জন ক্রিস্টিন গ্রাঁভিলি। যুদ্ধবন্দিদের গোপনে উদ্ধার করায় বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের হয়ে কাজ করতেন পোল্যান্ডের চর (Female Spy) ক্রিস্টিন। কাজের নিরিখে তাঁর সাফল্যের তালিকা বেশ বড়। শোনা যায়, তিনিই ছিলেন উইনস্টন চার্চিলের সবথেকে প্রিয় চর। সেটা হওয়া যে সহজ কথা নয় তা বলাই বাহুল্য। এরপর বলতে হয় নুর ইনায়েত খানের কথা। নাৎসিদের দখলে থাকা ফ্রান্সে রেডিও অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন নুর। মাসের পর মাস ধরে শুধুমাত্র তাঁর ভরসায় লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত ফ্রান্সের গুপ্তচররা। সবটাই হত গোপনে, এতটাই দক্ষ ছিলেন যে কখনও কাউকে বুঝতে দেননি তিনি কী সিগন্যাল পাঠাচ্ছেন, কাকে পাঠাচ্ছেন।
সকলেই যে বিশ্বযুদ্ধের আমলের এমন নয়। ২০১০ সালে শিরোনাম দখল করেন রাশিয়ার এক সুন্দরী গুপ্তচর। কথা বলছি অ্যানা চ্যাপমান সম্পর্কে। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে চরবৃত্তি সারতেন অ্যানা। টেকনোলজির বিষয়ে এতটাই দক্ষ ছিলেন তাঁকে পাকড়াও করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল পুলিশের কাছে। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের উন্নত করেছেন চরেরা । রূপের মোহে অন্যকে ভোলানোর মায়াজাল এখনও ছড়িয়ে রাখেন অনেকে। তবে ধরণ বদলেছে। সোশাল মিডিয়ার দৌলতে কাজ হাসিল আরও সহজ হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও হবে। একদিক থেকে দেখলে অন্য দেশের গুপ্তচরদের কেউই কখনও পছন্দ করে না। তাও নিজেদের অস্তিত্ব কৌশলে টিকিয়ে রেখেছেন এই চরেরা । কীভাবে বাঁচতে হয় এঁরা ভালমতো জানেন। কীভাবে মরতে হয়, সে কথাও জানেন তাঁরা। তাই পৃথিবী তাঁদের ভালবেসেছে, ঘেন্নাও করেছে, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেনি আজও।