পুজোর যাবতীয় উপকরণ কিন্তু প্রকৃতিজ। ফুল-বেলপাতা থেকে ধান-দুব্বো সবকিছুই। ইচ্ছে না থাকলেও পুজোর সূত্রে সবুজ প্রকৃতির কাছেই ফিরে যেতেই হয় আমাদের। সুযোগ থাকে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে ওঠার। সে ভয়েই হোক কিংবা সহজ কৃতজ্ঞতায়।
সব পুজোই আসলে প্রকৃতি পুজো। কিছু পুজো তো সরাসরিই বলে সেই কথা। যেমন বনদেবীর পুজো। দণ্ডকারণ্যের আদিবাসীরা, যাঁরা অনেকেই এখন উত্তরবঙ্গের অধিবাসী, তাঁরা বনদেবীর পুজো করে থাকেন নিয়ম করে। বনাঞ্চলের মানুষ, অরণ্য নির্ভর মানুষ কৃতজ্ঞতা জানাতে বনদেবীর পুজো করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের বনবিবির পুজো তো বিখ্যাত। দক্ষিণ রায়ের পুজোর কথাও জানা। এভাবে সরাসরি না হলেও যে কোনও পুজোই আসলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথাই বলে। ‘বিশ্ব উষ্ণায়ণ’, ‘প্রকৃতি বাঁচাও’ টাইপ বড় বড় এজেন্ডা নেই সেখানে। তবে পুজার উপকরণ বুঝিয়ে দেয় সেই কথা।
ফুল, বিল্বপত্র বা বেল পাতা, দুর্বা বা ঘাস, আম্রপল্লব বা আমপাতা, হলুদ, চাল, পাকা কলা, সুপুরি… প্রায় সব পুজোতেই উপস্থিত। কদিন আগেই গেল কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজোর দিনে ছিল দীপন্বিতা লক্ষ্মীপুজো। দুই লক্ষ্মীপুজোতেই লাগে ধানের ছড়া। কেন লাগে? যেহেতু মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ভাবনা হল খিদে। সেই খিদে নিবারণ করে ধান। কৃষি ভিত্তিক সভ্যতায় অন্নপূর্ণার চেয়ে বড় দেবতা আর কেই বা হতে পারে! এই কারণেই এককালে শস্যের দেবী হিসেবেই পূজিতা হতেন লক্ষ্মী। এই ভাবনাকে আরও সরাসরি মান্যতা দেয় নবান্ন পুজো। গ্রাম বাংলায় ধানের বীজ রোপণের আগে হয় নলপুজো। এই পুজো আসলে যে মাটিতে ধান রুইবে কৃষক তার পুজো।
আরও শুনুন: মহাবীরের মৃত্যুশোকেই ভাইফোঁটার সূত্রপাত, জানেন এই কাহিনি?
আগুনের প্রতি ভয়ই আগুনকে দেবতা করেছে? বিষধর সাপের প্রতি ভয়ই কী মনসা পুজোর অন্যতম কারণ? সৌরজগতে রাজা সূর্য। আমরা তার সহানুভূতির কিরণে লালিত সামান্য প্রজা। এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। অতএব, সূর্যপ্রণাম, সূর্যস্তব জরুরি। শুধু সূর্যকেই নয়, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মানুষ নদী, সমুদ্র, পাহাড়কেও পুজো করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আর কদিন পরেই যেমন ছট পুজো। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে এমন বহু পুজোর সরাসরি যোগও নেই হয়তো!
আরও শুনুন: দিওয়ালি সারা ভারতের আলোর উৎসব, কোথায় কেন পালিত হয় জানেন?
আসল কথা, বাড়িতে পুজো মানেই সকালে ওঠা। মানে ভোরের সঙ্গে দেখা। তারপর সাজি হাতে ফুল তোলা, বেলপাতা, পান-সুপুরির যোগার। ধূপ-ধুনোর আশ্চর্য পবিত্রবোধ! তাছাড়া এককালে এইসব বাজারে মিলত না। ফলে ইচ্ছে না থাকলেও প্রকৃতির কাছে যেতেই হত। কারণ পরিবারের, সন্তানের মঙ্গলকামনায় পুজো ছিল অতি জরুরি। মহাবিশ্বের সঙ্গে এরচেয়ে সহজে সেতুবন্ধন সম্ভব? অর্থাৎ কিনা সব পুজোই প্রকৃতি পুজো। প্রকৃতি আর মানুষের সহজ সম্পর্কের গল্প।