মোদি বলছেন, সিনেমা তৈরি না হওয়ার আগে পর্যন্ত তেমন কেউ চিনতেনই না মহাত্মা গান্ধীকে। অথচ ইতিহাস বলছে, বিদেশের তাবড় তাবড় মানুষরাও কথা বলেছেন ভারতের এই সাধারণদর্শন মানুষটিকে নিয়ে। গান্ধীকে নিয়ে কী মত ছিল তাঁদের? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
লোকসভা ভোটের বাজার, আর গান্ধীরা সেখানে থাকবেন না, তাও কি হয়? তবে ইন্দিরা বা রাহুল নন, এবার খোদ মহাত্মা গান্ধীকেই ভোট-আবহে টেনে আনলেন নরেন্দ্র মোদি। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি সাফ দাবি করে বসেছেন, গোটা বিশ্বে কেউ চিনতই না মহাত্মা গান্ধীকে। যতদিন না রিচার্ড অ্যাটেনবরো-র বিখ্যাত ‘গান্ধী’ ছবিটি মুক্তি পায়, ততদিন পর্যন্ত নেহাতই অচেনা ছিলেন তিনি। তাঁর আরও বক্তব্য, নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে যেভাবে পৃথিবীর মানুষ চেনেন, গান্ধীকেও তেমন করে চেনানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল সরকারের। অর্থাৎ ঘুরিয়েফিরিয়ে সেই কংগ্রেস সরকারের দিকেই আঙুল মোদির।
যদিও মোদি এ কথা এড়িয়ে গিয়েছেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে, এবং জাতীয় কংগ্রেসের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাসেও পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁকে অস্বীকার করার সাধ্য সেকালেও কারও ছিল না, এখনও নেই। বরং মোদি যেসব বিশ্বনেতার নাম করেছেন, মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে বারেবারে কথা বলেছেন তাঁরা। শুধু নেতারাই নন, বিশ্বের তাবড় মনীষীদের অনেকের সঙ্গেই চিঠিপত্রে বা মুখোমুখি সাক্ষাতেও কথা হয়েছে গান্ধীর।
আরও শুনুন:
মনোনীত হয়েছিলেন ৫ বার, রাজনীতিক নন বলেই কি নোবেল পাননি মহাত্মা গান্ধী?
মোদি যাঁদের কথা বলেছেন, সেই মার্টিন লুথার, রোজা পার্কসের গ্রেপ্তারির পর ৩৮১ দিনের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। আর এই পথের আদর্শ যে গান্ধীর কাছ থেকেই পাওয়া, সে কথা মনে করিয়েই তিনি বলেছিলেন, “যিশু আমাদের পথ দেখিয়েছিলেন, আর ভারতে গান্ধী দেখিয়েছেন যে সে পথে চলাও যায়।” বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গান্ধী যে তাঁর বড় হাতিয়ার, ১৯৫৮ সালে ভারতীয় সংবাদপত্রে লেখা এক প্রবন্ধেও সে কথা খোলাখুলি বলেছিলেন এই নেতা। একইভাবে নেলসন ম্যান্ডেলা গান্ধীকে বলেন এক ‘পবিত্র যোদ্ধা’।
শুধু তাঁরাই নন, গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কিংবা রমাঁ রল্যাঁর মতো চিন্তকও। রমাঁ রল্যাঁ বলেছিলেন, যিশুকে যদি শান্তির রাজপুত্র বলা হয়, একইভাবে সে খেতাব পাওয়ার যোগ্য গান্ধীও। ১৯৩১ সালে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক সেরে ফেরার পথে সুইটজারল্যান্ডে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন গান্ধী। আর আইনস্টাইন নিজেই চিঠি লিখেছিলেন গান্ধীকে, ১৯৩৯ সালে। সমসাময়িক সব রাজনীতিকের তুলনায় গান্ধীর ভাবনা আর আদর্শকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সেই সময়ে, পারমাণবিক বোমা তৈরির শোরগোলের মধ্যে গান্ধীর কথাই মনে করেছিলেন আইনস্টাইন। কেননা তাঁর কাছে শতাব্দীর সেরা মনীষা ছিলেন মহাত্মা গান্ধীই, যিনি মানুষের স্বভাবের ধ্বংসাত্মক দিকটি থেকে বেরোনোর পথ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের স্বভাবে যে ধ্বংস লেখা আছে, নাৎসি আক্রমণ থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি আইনস্টাইন তো সে কথা জানতেনই। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধও তাঁকে সে কথা বুঝিয়েছিল আরও। তাই গান্ধী সম্পর্কে আইনস্টাইন এ কথাও বলেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ কথা বিশ্বাস করতেই পারবে না যে এমন একজন রক্তমাংসের মানুষ এই পৃথিবীতেই হেঁটেচলে বেড়াতেন।
আরও শুনুন:
গান্ধীদের বিঁধতে গান্ধীই অস্ত্র! ‘বাপু’র জন্য কেন এত আক্ষেপ মোদির?
১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গান্ধী’ সিনেমার আগেই, মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে এমন শ্রদ্ধা পোষণ করতেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা। সুতরাং মোদি যে অভিপ্রায় থেকেই এ মন্তব্য করুন না কেন, তাঁকে কিন্তু আদৌ সমর্থন করছে না ইতিহাস।