এই প্ল্যাটফর্মে ৩০% অফ, তো ওই প্ল্যাটফর্মে ৪০%। ছাড়ের হিসাব রাখতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কেনাকাটার ধুম। তাতে জিনিসপত্র যেমন জমা হচ্ছে, তেমন মনের উপরও জমছে মেঘ। ভাবছেন তো, ব্যাপারটা কী? আসুন তাহলে বিশদে শুনেই নেওয়া যাক।
নিজের হাতে দেখে নেড়েচেড়ে একটা জিনিস কেনা। যার জন্য কেনা হচ্ছে, তার কথা মাথায় রেখে, জিনিস পছন্দ করা। শেষ কবে, আমরা এমনটা করেছি? বলা যায়, এই অভ্যেস প্রায় উবেই যেতে বসেছে। বদলে জাঁকিয়ে বসেছে অনলাইন শপিং-এর হুড়োহুড়ি। আর সেখানে চুম্বক আকর্ষণ হচ্ছে ঢালাও অফার। নানা নামে, বিভিন্ন দিনের মাহাত্ম্য অনুসরণ করে ফিরে ফিরে আসে এই ফ্ল্যাশ সেল। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পসরা সাজিয়ে বসে। আর চলতে থাকে অফারের প্রতিযোগিতা। সেই অফারের পাল্লায় পড়ে গোটাকয় জিনিস কেনা হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু অজান্তে কি তা আমাদের মনকেও প্রভাবিত করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিশ্চিতই করে।
আরও শুনুন: চেনা-পরিচিতের বিয়েতে নেমন্তন্ন না পেয়ে অভিমান! নিজেকে সামলাবেন কীভাবে?
এমনিতে কেনাকাটা মন্দ নয়। অনেকে বলেন, শপিং করলে মন ভালো থাকে। তা ছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনও কোনও জিনিস বেশ কম দামেও পাওয়া যায়। হয়তো যে জিনিস কেনা সাধ্যের বাইরে থাকে, এই সেলের কারণে তা নাগালের মধ্যেই চলে আসে। সেল-এ জিনিসপত্র কেনাকাটা করা তো আমাদের বহুদিনের অভ্যাস। তাহলে এখানে মুশকিলটা ঠিক হচ্ছে কোথায়? দেখা যাচ্ছে, কেনাকাটা যত না নিজের প্রয়োজনভিত্তিক তার থেকেও বেশি হয়ে উঠছে অফারকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, অফার দিচ্ছে বলেই একটা জিনিস কিনে ফেলা। প্রয়োজন না থাকলেও বাড়তি কেনা, এসব তো আকছারই হচ্ছে। এর ফলে জিনিসের উপর জিনিস কেনা হচ্ছে। অনেক সময় তার ব্যবহারই হচ্ছে না। বহু জিনিস নষ্ট হচ্ছে, তবু কেনাকাটার ধুম থামছে না। কেননা ফ্ল্যাশ সেল খুড়োর কল হয়ে ঘুরে ফিরে ঠিক আসেই। আর ক্রেতাও, নিজের প্রয়োজন শিকেয় তুলে অফারের ফাঁদে পা দিয়ে দেন। শুধু তাই-ই নয়, কে কোন অফারে বেশি লাভবান হলেন, তা নিয়েও চলতে থাকে প্রতিযোগিতা। একটু এদিক ওদিক হলেই আপশোস। মনে হয়, আর একটু বেশি খোঁজখবর করলে কম দামেই কেন যেত। হাতের সামনেই সব ছিল, কেন মিস্ হয়ে গেল! কেনাকাটা, যা কিনা আনন্দের জিনিস হয়ে উঠতে পারত, ঘুরেফিরে তা হয়ে যাচ্ছে মন খারাপের। নানা সমীক্ষা বলছে, অফারের এই হিড়িক মানুষকে অর্ডার দিতে প্রলুব্ধ করছে। নিজের প্রয়োজন বুঝে কেনাকাটার রীতিকেই পালটে দিচ্ছে। প্রত্যেকের যেমন নিজেকে প্রকাশ করার আলাদা ধরন আছে, তেমন বুঝেশুনে কেনাকাটারও ধরন থাকে। সেই অভ্যাসটাই বদলে যাচ্ছে। এমনকী নিকটজনের জন্য যদি কেউ উপহারও কেনেন, তাঁর মাথায় প্রথম ঘুরছে কোথায় বেশি অফার মিলবে। এই যে বদল তা মোটেও সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
আরও শুনুন: ৩৪ লিটার মদ্যপান! নেশায় এক মাস কাবু যুবক! গড়লেন নতুন রেকর্ডও
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যাটা বেশ গভীরেই। সোশ্যাল মিডিয়া কিছুতেই কাউকে থিতু হতে দেয় না। যত বেশি কন্টেন্ট দেখা যায়, তার দিকেই এগিয়ে দেয়। ঠিক সেই কাজটিই করছে এই ফ্ল্যাশ সেল। কোন জিনিস দরকার, কেন দরকার সে সব ভাবার অবকাশই দিচ্ছে না। বরং আরও বেশি কেনায় প্ররোচনা জোগাচ্ছে। শুধু তাই নয়, কে কত বেশি জিনিস কিনতে পারল, দৌড় চলছে তা নিয়েও। উপরন্তু বাড়ছে একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া অর্থাৎ ইউজ-অ্যান-থ্রোর প্রবণতা। একই সঙ্গে এই জিনিস কেনাকাটা করা এবং তা দেখানোর মানসিকতাও ক্রমশ বাড়ছে। ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা বাদ দিয়ে কেনাকাটার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে এমন অনেক কিছু, যার আদতে প্রয়োজনই ছিল না। আবার, একটা জিনিস অর্ডার দেওয়া হয়েছে, অথচ তা পছন্দসই এল না। কিংবা রং পছন্দ হল না। তার জন্য আনবক্সিং পর্ব থেকেই ভিডিও করা। রিফান্ড হবে কি-না সেই নিয়ে বাড়ে টেনশন! একদিকে কেনাকাটা বাড়া, অন্যদিকে বাড়তে থাকা এই ধরনের সমস্যা। সব মিলিয়ে অফারের ফাঁদে পা দিয়ে মানুষ যে খুব শান্তি পাচ্ছে এমনটা নয়। এর প্রতিকার কোথায়? উত্তরে অনেকেই বলছেন ‘রিটেল থেরাপি’। অর্থাৎ নিজের যা দরকার তা নিজের মতো করে জেনেবুঝে প্রশ্ন করে দেখে নিয়ে তবে তা কেনা। যেমনটা দোকানে হয়। সেখানে অফারের হয়তো ঘনঘটা নেই, কিন্তু বাড়তি সময়সাও নেই, যা মনের উপর চাপ তৈরি করতে পারে। তবে, অফারের মোহ কাটিয়ে সেই বিন্দুতে কি এখন ফেরা আর সম্ভব? এ প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়।