মহালয়ার ভোরে রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা বাঙালির চিরকালের অভ্যাস। অথচ এর কয়েক মাস আগেই মহিষমর্দিনীর পুজোয় মাতে কালনাবাসী। মূর্তি হুবহু দেবী দুর্গার মতোই। তবে শরৎ বা বসন্তে নয়, এই দেবীর পুজো হয় বর্ষাকালে। কীভাবে শুরু হয়েছিল এই পুজো? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
শরৎকালে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন রামচন্দ্র। সেই থেকেই মর্তে দুর্গাপুজোর প্রচলন। বসন্তকালে বাসন্তীপুজোও হয় বটে, তবে তা দুর্গাপুজোর মতো বিশ্বজনীন উৎসবের স্বীকৃতি পায়নি। অথচ বর্ষাকালেও দেবীর এক বিশেষ রূপের পুজোর চল রয়েছে। দীর্ঘ ৩০০ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে সেই পুজোর সঙ্গে।
:আরও শুনুন:
মহেশ্বরের উগ্র রূপ, মাঘের অষ্টমীতে কালভৈরব আরাধনায় মেলে বিশেষ ফল
কথা বলছি কালনার মহিষমর্দিনী পুজো সম্পর্কে। শোনা যায়, স্বপ্নে এই পুজোর আদেশ পেয়েছিলেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ইশ্বরীপ্রসাদ পালচৌধুরী। দেবীর নির্দেশেই প্রায় ৩০০ বছর আগে শুরু হয় পুজো। এক নয়, একাধিক কিংবদন্তি জড়িয়েছে এই পুজোর সঙ্গে। তাতে কালের প্রলেপ পড়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। তৈরি হয়েছে পুজোর ইতিহাস নিয়ে একাধিক মতান্তর। বদলায়নি কালনাবাসীর ভক্তি। দেবী মহিষমর্দিনীকেই রক্ষাকর্ত্রী মনে করেন সেখানকার অনেকে। পুজো হয় বছরের নির্দিষ্ট কটা দিন। তবে দেবীর মন্দিরে সারা বছর পুজো দিতে আসেন ভক্তরা। প্রতি বছর অগাস্ট মাসের শুরুর দিকে এই পুজোর দিন পড়ে। বঙ্গে তখন ভরা বর্ষাকাল। শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে একদিকে যেমন বাবার মাথায় জল ঢালতে ছোটেন শিবভক্তরা অন্যদিকে তখনই মহিষমর্দিনীর আরাধনায় মাতে কালনাবাসী। পুজোর নিয়ম দুর্গাপুজোর মতোই। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী চারদিনের পুজো। সেইসঙ্গে বসে বিরাট মেলা। শুধু কালনা নয়, এইসময় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ভিড় জমান মহিষমর্দিনীর পুজোয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ভক্তভরে মায়ের কাছে কিছু চাইলে সে প্রার্থনা অবশ্যই পূরণ হয়।
:আরও শুনুন:
কণ্ঠে তুলসীর মালা ধারণ, শুধুই ধর্মীয় রীতি, নাকি আছে স্বাস্থ্যেরও উপকার?
এবার আসা যাক, মূর্তির প্রসঙ্গে। দেবী সিংহবাহনা, দশভুজা। হাতের অস্ত্রও দেবী দুর্গার মতোই। পদতলে ত্রিশূলবিদ্ধ মহিষাসুর। সেই থেকেই দেবীর এমন নাম। মূর্তিতে নেই লক্ষ্মী-গনেশ-কার্তিক-সরস্বতী। আলাদা করে নেই মহাদেবের উপস্থিতি। রয়েছেন দেবীর দুই সখী। একচালা মূর্তির দুইপাশে থাকে জয়া-বীজয়া। মূর্তির বিশেষত্ব বলতে দেবীর মুখ। সাধারণ মূর্তির তুলনায় মহিষমর্দিনীর মুখ খানিক বড়। প্রশান্তময়ী সদাহাস্য দেবী। সনাতনী রুদ্রমূর্তি গায়ের রং হলুদ। মহিষাসুরের রং গাঢ় সবুজ। তাঁর মূর্তিও ভীষণ বললে ভুল হয় না। এই পুজোয় ছাগবলির চল রয়েছে। সপ্তমী, অষ্টমীতে বলি হয়। নবমীতে মূলত মানসিক পূজা। এছাড়া দেবীর নৈবেদ্যও সাজানো হয় বিশেষভাবে। তবে পুজোর মূল আকর্ষণ বিসর্জন। প্রথা অনুযায়ী, গভীর রাতে দেবীর নিরঞ্জন সম্পন্ন হয়। সেইসময় গোটা কালনা অন্ধকার করে রাখা হয়। দেবীর কাঠামো গঙ্গার ঘাটে সাতদিন ডোবানো থাকে। পরে সেই কাঠামো তুলে মন্দিরে রাখা হয়। পুজো শেষ হলেও মেলা চলে। অন্তত ১৫ দিন পর মেলা শেষ হয়। সব মিলিয়ে মহিষমর্দিনী পুজো উপলক্ষে গোটা কালনায় উৎসবের আমেজ থাকে। যা কলকাতার দুর্গাপুজোর উত্তেজনাকেও টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে বইকী!