ভারতীয় নারীদের মধ্যে সচরাচর দ্রৌপদী নাম চোখে পড়ে না। হয়তো মহাভারতের এই প্রধান চরিত্রটির সঙ্গে যে দুর্ভাগ্যের কাহিনি জড়িয়ে আছে, সে কথা মনে রেখেই। কিন্তু ঘটনাচক্রে এবার দেশের প্রথম নাগরিক হলেন সেই নামের এক মেয়েই। তাঁর হাতেই কি তাহলে বদলে যাবে এই চিরাচরিত ধারণা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
পুরাণ-মহাকাব্যের চরিত্রের নাম অনুসারে সন্তানের নামকরণ করার প্রচলন রয়েছে ভারতীয় সমাজে। তবে খল বা ক্রূর চরিত্রগুলিকে অনেকেই সে তালিকা থেকে বাদ দেন। কিন্তু, খল চরিত্র না হওয়া সত্ত্বেও, এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় আরও একটি নাম। খলনায়িকা নন, বরং মহাকাব্যের অন্যতম নায়িকা তিনি। কিন্তু মহাভারত নিয়ে এ দেশে যতই শ্রদ্ধার আবহ থাকুক, সাধারণত দ্রৌপদী নাম রাখা হয় না মেয়েদের। হয়তো মহাভারতের এই প্রধান চরিত্রটির সঙ্গে যে দুর্ভাগ্যের কাহিনি জড়িয়ে আছে, সে কথা মনে রেখেই এমনটা ঘটে। স্বয়ংবর সভায় নিজের প্রার্থিত পুরুষকে পাওয়ার পরেও পাঁচ স্বামী নিয়ে বৈবাহিক জীবন কেটেছে এই অনন্যা রমণীর। বহুভোগ্যা বলে বারবার কটাক্ষের মুখেও পড়তে হয়েছে দ্রৌপদীকে। পঞ্চপাণ্ডবের মতো বীর স্বামী, কৃষ্ণের মতো বন্ধু থাকা সত্ত্বেও কম অপমান, অত্যাচার সইতে হয়নি তাঁকে। কখনও পাশা খেলায় পণ রাখা হয়েছে এই অপূর্ব সুন্দরী নারীকে, কখনও তাঁর বস্ত্রহরণ করা হয়েছে ভরা সভায়, কখনও বা জয়দ্রথের মতো কোনও আত্মীয়ই তাঁকে অপহরণ করতে চেয়েছেন। তাই মহাভারতকার দ্রৌপদীকে বলেছেন নাথবতী অনাথবৎ।
আরও শুনুন: হারিয়েছেন স্বামীকে, অকালমৃত্যু দুই সন্তানের… শোকের ঝড় পেরিয়ে রাইসিনা হিলসে দ্রৌপদী মুর্মু
ভাগ্যবিপর্যয়ের দরুন বিপর্যস্ত এই চরিত্রের নাম সে কারণেই হয়তো বেছে নিতে দ্বিধা হয় অনেকের। মহাশ্বেতা দেবীর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দ্রৌপদী’-ও ইঙ্গিত করেছিল সেই দুর্ভোগের দিকেই। কিন্তু সম্প্রতিই ভারতের রাজনীতিতে স্বমহিমায় উঠে এসেছে এই নামটি। সেই নামের এক নারীই আজ হয়ে উঠেছেন দেশের প্রথম নাগরিক। তাঁর জীবনেও বিপর্যয় কম নেই। যেন মহাভারতের দ্রৌপদীর মতোই, পুত্রশোকের মুখোমুখি হয়েছেন আধুনিক ভারতের এই দ্রৌপদীও। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে দুই ছেলের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। কেবল সন্তানশোকই নয়, স্বামীকেও হারিয়েছেন দ্রৌপদী মুর্মু। তবু হার মানেননি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই আদিবাসী কন্যা। প্রথম জীবনে শিক্ষিকা থেকে পরবর্তী কালে মন্ত্রী, তারপর রাজ্যপালের দায়িত্বও দক্ষ হাতেই সামলেছেন দ্রৌপদী মুর্মু। আর অবশেষে, রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে তাঁকেই বেছে নিয়েছে এ দেশের শাসক দল। সকলের রায়ে সেই সম্মানের মুকুট শেষ পর্যন্ত উঠেছে তাঁরই মাথায়। ওড়িশার এক অনগ্রসর গ্রাম থেকে দেশের পিছিয়ে থাকা জনজাতির এক নারী পা রেখেছেন রাইসিনা হিলের মসনদে। তিনিই যেন ফের মনে করিয়ে দিলেন, দ্রৌপদী আসলে লড়াই করে বিপর্যয় পেরিয়ে যাওয়ারই সমনাম। মহাভারতের রাজনীতি যে নারীর প্রতি অপমান ছুঁড়ে দিতে দ্বিধা করেনি, ভারতের রাজনৈতিক তথা সাংবিধানিক শীর্ষে তাঁর সমনাম্নী এক নারীর উত্থান যেন হয়ে রইল নিয়তিরই এক ইঙ্গিত।