“ভাবের হিল্লোলে আমার মন দোলে- আর মন-দোলায় বসিয়া আমার মনের মানুষ দোলেন। যিনি অসঙ্গ, তিনি আবার সঙ্গের সঙ্গী- যিনি মনের অগোচর, তিনি আবার মনের মানুষ- যিনি অচল অটল, তিনি চঞ্চল- যাঁহার চরণে কোটি ব্রহ্মাণ্ড দোলে, তিনি আজ প্রেমের টানে দোদুল্যমান। অদ্ভুত দোল-লীলা!- অদ্ভুত রহস্য।’- দোলের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যায় এ-কথা বলেছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। রঙের ভিতর দিয়ে প্রেমে পৌঁছনোর কথাই যেন বলে এই উৎসব।
রঙের ফোয়ারা প্রকৃতি জুড়ে। সে-নেশা লেগেছে মানুষের মনেও। রঙের উৎসব যেন সবরকম মালিন্যের উপর এনে দেয় নতুনের ছোঁয়া, উজ্জ্বলতা। আর এই উৎসবের সঙ্গেই নিবিড় যোগ ঈশ্বরের। রঙের উৎসব যেন এক রকমের আরাধনাই। আর সেই আরাধনা যদি সফল ভাবে করা যায়, তাহলে অপরাধ থেকেও ঘটে মুক্তি। কিন্তু কেন? কেন এমন ছাড়পত্র প্রচলিত হল এ সমাজে?
-: আরও শুনুন :-
কেমন হবে বিরোধিতা? শ্রীচৈতন্যের যুক্তি প্রাসঙ্গিক নির্বাচনের মরশুমেও
দোলের সঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের লীলার যোগ প্রাচীন। সেই মদনোৎসব থেকে রঙের ঝরনার বিবর্তনে বদলে বদলে গিয়েছে পটভূমি। তবে, এই যোগাযোগ ক্ষীণ হয়নি। বরং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে তাতে এসেছে নতুন জোয়ার। এই রঙের জোয়ারের সবথেকে বড় কথা হল, তা বিভেদ ভোলানর মন্ত্র দেয়। বালক কৃষ্ণের কাহিনির মধ্যেও ছিল সেই ইঙ্গিত। পুতনার বিষ-স্তন্য পান করে কালোবরণ হয়েছেন গোপাল। এদিকে রাধা ও তাঁর সখীরা সকলেই গৌরী। এ ব্যথা কী যে ব্যথা তা শুধু কৃষ্ণই জানেন! তো তিনি মা যশোদার কাছে গিয়ে অনুযোগ করলেন এ ব্যাপারে। অর্থাৎ ভাবখানা এই যে, এমনটা তো চলতে পারে না। মা-ও ছেলেকে ভোলাতে বলেলেন যে, একদিন কৃষ্ণও নাহয় গোপীদের গিয়ে নানা রঙে রাঙিয়ে দেবেন। তাহলেই আর বর্ণের ভেদ থাকবে না। সব এক হয়ে যাবে। এখন এ কাহিনি হয়তো কৃষ্ণ-গোপীর লীলামাহাত্ম্য প্রকাশেরই একটি অঙ্গ। তবে সার কথাটি হল, ওই বিভেদ ঘোচানো। এরপর দোল উৎসবের চেহারা কত না বদলেছে! ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে কৃষ্ণ-গোপীর এই রঙের খেলা নানা তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে মানুষের কাছে। তবে, দোলের রং যে বিবর্তনের মধ্য দিয়েই যাক না কেন তা মানুষের হৃদয়কে আরও দ্রব ও সহিষ্ণু করতে চেয়েছে চিরকাল। যা না হলে, মানুষে মানুষে মিলনের কাহিনি ব্যর্থ হয়ে যায়।
-: আরও শুনুন :-
রঙের উদ্ভাসে শহরের যেখানে বারোমাস বসন্ত-উৎসব
রঙের এই উন্মেষ তো প্রকৃতিতেই। প্রকৃতির সেই দান মানুষ মিশিয়ে নিতে চেয়েছে তার আরাধনায়। আর ঈশ্বর তার কাছে ধরা দিয়েছেন সেভাবেই, যেভাবে সে ঈশ্বরকে পেতে চেয়েছে। সেই যে গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, যে আমাকে যেভাবে ভজনা করেন, আমি তাঁর কাছে সেভাবেই প্রকাশিত হই, সেই কথার অনুরণন যেন এই সমগ্র দোল উৎসবের মধ্যেও। ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ। আবার তাঁকে ভক্তির ডোরে বেঁধে অন্তরের অনেক কাছাকাছি অনুভব করা যায়। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বলছেন, “যোগের ঈশ্বর নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন, কিন্তু ভক্তের ভগবান প্রেমাকর্ষণ-চঞ্চল হৃদয়-সিংহাসনে বসিয়া দোল-লীলা করেন। জ্ঞানবলে পরমভাবের ভাবুক হইয়া ঈশ্বরত্ব লাভ করা যায়, আবার প্রেম-ডোরে শ্রীহরিকে বাঁধিয়া আনিয়া ভক্ত-ভাবের ভাবুক করা যায়। আমি যদি কাঁদি তো আমার হরি কাঁদেন- আমি যদি হাসি তো তিনি হাসেন- আমি যদি রাগ করি তো তিনিও রাগ করেন। ভাবের হিল্লোলে আমার মন দোলে- আর মন-দোলায় বসিয়া আমার মনের মানুষ দোলেন। যিনি অসঙ্গ, তিনি আবার সঙ্গের সঙ্গী- যিনি মনের অগোচর, তিনি আবার মনের মানুষ- যিনি অচল অটল, তিনি চঞ্চল- যাঁহার চরণে কোটি ব্রহ্মাণ্ড দোলে, তিনি আজ প্রেমের টানে দোদুল্যমান। অদ্ভুত দোল-লীলা!- অদ্ভুত রহস্য।” এই যে ভক্তির ডোরে, ভক্ত আর ভগবানের দুলে ওঠা- এই রহস্যই দোলের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এর সঙ্গে মিশে গেল প্রকৃতির অপরিমেয় করুণা। দু-হাত উজাড় করে প্রকৃতি যেন তার আপন সম্পদ বিলিয়ে দিল মানুষের দরবারে। বসন্ত তাই সন্ন্যাসী রাজা। তার সম্পদের শেষ নেই। আবার সেই সম্পদ বিলিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যেতেও তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। প্রকৃতির এই মনের কথা যেন ঈশ্বরেরই কথা। অতএব মানুষ দেখে ‘প্রকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির ঈশ্বরের সঙ্গে দোল’। প্রকৃতি তার দেবতার সঙ্গে দোলে মত্ত। আর সেই প্রকৃতির অংশ হয়েই মানুষ নিজেও তার ঈশ্বরকে প্রেমের রঙে রাঙিয়ে তুলছে। রঙের ভিতর মিশে আছে এক হওয়ার বাসনা। যার বীজ রইল ওই প্রেমে।
অতএব ‘পদ্মপুরাণ’ জানিয়ে দিল, “দোলে দোলায়মান দক্ষিণমুখ-বিশিষ্ট শ্রীকৃষ্ণকে একবার দর্শন করিয়া নিঃসংশয়ে জনগণ সকল অপরাধ হইতে মুক্ত হয়।” এ কেবল দৈবীকৃপা মাত্র নয়। কৃষ্ণের এ রূপ যিনি দেখছেন, তিনি চিনেছেন প্রেমের স্বরূপ। সেই প্রেম, যা না থাকলে ‘আমি’-র অচল পাথর বিন্দুমাত্র সরে না। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “আরো প্রেমে আরো প্রেমে/মোর আমি ডুবে যাক নেমে।” দোলের ভিতরকার কথাটি হল, সেই প্রেমের অনুশীলন। যে প্রেমে সব বিভেদ মুছে যায়। আমির আবরণ খসে গিয়ে মানুষ প্রকৃতি, আর ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারে। ঈশ্বর-প্রকৃতি-মানুষের সংযোগে অন্তরে যে আনন্দের দোল, তাই-ই মূলত উৎসব। প্রেমে পৌঁছনোর সাধনা সহজ নয়। যোগের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনই শক্ত এ কাজ। আর এই অনুশীলন যদি না থাকে, তবে, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নানা রকম অহংকারের বিষ আমাদের জর্জরিত করে। মানুষে মানুষে ভেদাভদের ফাটল আরও বাড়তে থাকে। দোলের ভিতর সেই প্রেমের কথা। তারই প্রতীক হয়ে ধরা দিচ্ছেন দোলে দোলায়মান শ্রীকৃষ্ণ। তাই হয়তো পুরাণ বলছে, সেই মূর্তি দর্শনে সব অপরাধ থেকে মুক্তি মেলে। আসলে প্রেমে না-পৌঁছতে পারাটাই অপরাধ কিংবা অধর্ম। দোল উৎসব সেখান থেকে আমাদের দেয় মুক্তির সন্ধান। তাই দোল এত আনন্দের, এমন রঙিন।