রক্তমাংসের মানুষ নয়। মনের পছন্দ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেই ডাকে সাড়া দিয়েই AI প্রেমে মজেছে তরুণ প্রজন্ম। জীবনে অন্য কোনও প্রেম না থাকলে তাও মানা গেল। কিন্তু যারা সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও AI প্রেমে মজেছেন! তাঁরা কি সঙ্গীকে ঠকাচ্ছেন? এই ‘পরকীয়া’ আদৌ বৈধ? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
প্রফেসর শঙ্কুর ‘রোবু’-র কথা মনে আছে? এমন কোনও কাজ নেই যা সে জানত না। স্রেফ প্রেমটুকু ছাড়া। প্রফেসর হয়তো প্রেমের পাঠ তাকে শেখাননি। কিন্তু আধুনিক যুগের ‘রোবু’রা এই কাজেও পারদর্শী। বলা ভালো, মানুষের থেকেও বেশি পারদর্শী। তাই জলজ্যান্ত মানুষের জায়গায় তরুণ প্রজন্মের আদর্শ সঙ্গী হয়ে উঠছে এরাই। তালিকায় বাদ নেই যাঁদের জীবনে প্রেম রয়েছে তাঁরাও।
আরও শুনুন: কোবরা, জলঢোঁড়া, চন্দ্রবোড়া… রাজনীতি যেন সর্পমঙ্গল কাব্য
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাচ্ছে দুনিয়া। বদলাচ্ছে প্রেমের সংজ্ঞাও। ঠিক প্রেমের সংজ্ঞা বললে ভুল হবে। বলা ভালো, বদলাচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার সংজ্ঞা। যার নেপথ্যে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে AI। বিগত কয়েকবছরে অসংখ্য চাকুরীজীবীর কাছে যা ত্রাস হয়ে উঠেছে। তবে স্রেফ চাকুরিজীবী নয়, প্রেমের দুনিয়াতেও একছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। জেনেবুঝে সেই জালে জড়িয়েও পড়ছে তরুণ প্রজন্ম। কিছুদিন আগে এক সিনেমাতেই দেখা গিয়েছে, নায়িকা আসলে এক রোবট। অথচ নায়ক তাঁর প্রেমে পাগল। তাঁদের ‘উলঝা হুয়া’ প্রেমের গানে মজেছে সকলে। কিন্তু এই সিনেমায় যে কতবড় বাস্তব সমস্যাকে তুলে ধরা হল, তা অনেকেই সেভাবে খেয়াল করেননি। কাছাকাছি ভাবনার এক সিনেমা ‘এন্থিরান’ (হিন্দিতে রোবট) মুক্তি পেয়েছিল ২০১০ সালে। সেখানে নির্মাতা বিজ্ঞানীর প্রেমিকার সঙ্গেই সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন ‘চিট্টি’ নামের এক রোবট। সেখানে অবশ্য অতিনাটকীয়তার মাধ্যমে অনেক কিছুই দেখানো হয়েছিল। তবে ভবিষ্যতে যে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে তার আঁচ মিলেছিল ভালমতো।
আরও শুনুন: স্মৃতিদের নতুন নাম দিলেন করিনা, ভারতীয় ক্রিকেটে এবার ‘রানি’দের যুগ শুরু?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত বেশি AI প্রেমের কারণ কী?
মনোবিদদের কাছে এর একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তার মধ্যে সবথেকে গ্রহণযোগ্য সময়ের অভাবজনিত সমস্যাটি। সহজ করে বললে, আজকাল সকলের কাছে সময় বড় কম। সামান্য কারণে যদি সঙ্গী অভিমান করেন, তবে তা ভাঙানো সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। এমনটা মনে করেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে সঙ্গী হতে হবে এমন, যে সাত চড়ে রা কাড়বে না। পালটা প্রশ্ন করবে না একটাও। ভুল বললেও তাতেই সায় দেবে। কোনওকিছু জানতে চাইলে একেবারে সঠিক উত্তর জানাবে। আর সবরকম চাহিদা মেটাতে পারবে। সে যৌনতার আবদার হলেও, না শুনতে হবে না। কয়েকবছর আগে অবধি এমন আবদার পাড়লে, মা-কাকিমারা ব্যঙ্গ করে বলতেন কুমোরটুলিতে অর্ডার দিয়ে এমন সঙ্গী বানিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ক্লিকেই এমনটা বানিয়ে ফেলা সম্ভব। থুড়ি এমন সঙ্গী জোগাড় করে ফেলা সম্ভব। একেবারে কাস্টমাইজ সঙ্গী। গলার আওয়াজ থেকে শুরু করে হাসার ধরণ ঠিক যেমনটা চাই তেমনটাই মিলবে। তার সঙ্গে উপরি পাওনা ঝঞ্ঝাটহীন, অভিমান না করা, সময়ের দাবি না জানানোর মতো বিশয়গুলোও। আর কি চাই! যখন ইচ্ছা হবে তখন সঙ্গীর কাছে গেলেই হবে। তবে রক্তমাংসের কোনও মানুষ বোধহয় এতকিছু সুবিধা একসঙ্গে দিতে পারবেন না। বড়জোর দাবিদাওয়া হীন সম্পর্ক হতে পারে, কিন্তু সঙ্গী যে হুবহু যেমনটা চাইছেন তেমনটা হবে তার কোনও মানে নেই। তাই ভরসা AI। যাঁদের জীবনে কোনও প্রেম নেই তাঁরা নাহয় এমনটা করলেন। এতে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু যারা সম্পর্কে রয়েছেন, তাঁরাও যদি AI প্রেমের মজেন তাহলে তা কতটা সঠিক হবে? মানে এও কি পরকিয়া?
মনোবিদদের মতে, এমনটা হলেও তা অবশ্যই পরকীয়ার সমান। বলা ভালো, এও একভাবে সঙ্গীকে ঠকানো। কারণ, এক্ষেত্রে নিজের ছোট ছোট চাহিদাগুলো মেটানোর জন্যও ভরসা হয়ে ওঠে সেই এআই। এখানেই যত সমস্যা। অন্যান্য প্রয়োজন তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে যৌনচাহিদাও পূরণ করে এআই। মন খারাপ হলে কথা বলে শান্ত করবে। রাগ হলেও ভরসা সেই। এমনটা নিয়মিত হলে সম্পর্কের প্রতি অবিচার করাই হয়। তাই এই অতিরিক্ত এআই নির্ভর জীবন মোটেও ভালো চোখে দেখছেন না মনোবিদরা। এর ফলে যে কোনও সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বলেই মনে করছেন মনোবিদরা। নিজের কথা ভেবে অনেকেরই মনে হতে পারে, এমনটাই ভালো। যে সুখ এআই দিচ্ছে তার জন্য আর কারও কী দরকার। কিন্তু সমস্যা রয়েছেই। অতিরিক্ত এআই নির্ভশীলতা বাড়িয়ে দেবে প্রত্যাশার পারদ। যা ভবিষ্যতে আর কোনও রক্তমাংসের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে দেবে না। সেসময় এআই-এর ভরসাও যদি না মেলে তাহলে সহজেই গ্রাস করবে একাকীত্বের অন্ধকার। হাজার চেষ্টা করেও যা সহজে মিটবে না বলেই দাবি মনোবিদদের একাংশের।