কাজের বোঝা ঘাড়ের উপর। দম ফেলার সময় নেই। কাজ সামলাতে গিয়ে অবকাশ, বিনোদন সবকিছুই যেন প্রায় ভেসে গিয়েছে। হাল হামলের প্রায় প্রত্যেকেরই একই অভিযোগ। তা ইদানীং কি মানুষকে বেশি কাজ করতে হচ্ছে? কী বলছে কাজের ইতিহাস? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করতে হবে দেশের যুব সম্প্রদায়কে। কিছুদিন আগে এমন দাবি তুলে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ইনফোসিস প্রধান নারায়ণ মূর্তি। দেশজুড়ে এর কম প্রতিবাদ হয়নি। বিতর্কের পর্ব মিটলেও কাজের চাপ নিয়ে চর্চা বন্ধ হয়নি এখনও। অনেকেই দাবি তোলেন রোজকার কাজের চাপে জীবন ওষ্ঠাগত। শরীর খারাপের কারণও এই কাজের চাপই। কিন্তু ইতিহাস কি বলছে, এ ব্যাপারে?
আরও শুনুন: যাচ্ছেতাই অপমান করেন কর্মীরা, তবু সেই রেস্তরাঁতেই সাধ করে খেতে যান সকলে
একেবারে শুরু থেকেই ধরা যাক। ইতিহাস বলছে, সেই প্রস্তর যুগেও মানুষ দিনে অন্তত ৫ ঘণ্টা কাজ করতেন। তাও কোনও ছুটি ছাড়াই। অর্থাৎ বছরে ৩৬৫ দিনই কাজ করতেন প্রস্তর যুগের মানুষজন। এদিকে মিশরেও খানিকটা একইরকমের ছবি। সেখানে সপ্তাহে দিনের হিসাব খানিক আলাদা। মিশরীয় হিসাবে এক সপ্তাহে ১০ দিন। সেখানে আটদিন ৮ ঘণ্টা করে কাজের চল ছিল। আর দুদিন বিশ্রাম নিতেন সকলে। যদিও কাজ মানে স্রেফ কায়িক পরিশ্রম নয়। ছবি আঁকা, গান গাওয়া, উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এইসবও কাজের মধ্যেই ধরা হত প্রাচীন মিশরে। একইভাবে ইজরায়েলেও দিনে আট ঘণ্টা কাজের চল ছিল। হিসাবটা খানিক বদলে যায় রোমে। সেখানে যারা দাস হিসেবে নিযুক্ত তাঁদের কাজ করতে হত ২৪ ঘণ্টাই। তাও কোনও ছুটি ছাড়া। কিন্তু যাঁরা সাধারণ শিল্পী তাঁরা দিনে মাত্র ৬ ঘণ্টা কাজ করতেন। এখানেও উৎসবের বহর নেহাতই কম ছিল না। সার্কাস লেগে থাকত হামেশাই। তাই কাজও হত মূলত ওই উৎসবকে কেন্দ্র করেই। প্রাচীন ইংল্যান্ডের মানুষজন দিনে আট ঘণ্টা কাজ করতেন। ছুটি থাকত স্রেফ রবিবার। ১৭ শতকের দিকে দিনে ১০ ঘণ্টা কাজের চলও ছিল। শোনা যায়, ফ্রান্সে দীর্ঘদিন এই ব্যবস্থা চলেছিল। যেখানে কর্মীদের দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতেই হত। এর ঠিক পরের শতাব্দীতেই ইংল্যান্ডে চালু হল দিনে ১১ ঘণ্টা কাজের নিয়ম। ঐতিহাসিকদের গবেষণাতেই প্রমাণ মেলে, একসময় দিনে ১১ ঘণ্টা কাজ করতেন লন্ডনের শ্রমিকরা। সেই হিসেবে বছর ২০৮ দিন টানা কাজ। এরপর এল দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজের হুকুম। বেশিদিন নয়, ১৯ শতকের গোড়ার দিকেই এমন নিয়ম চালু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। এই সময়টা শ্রমিকদের উপর রীতিমতো অত্যাচার চালাতেন মালিক শ্রেণীর লোকজন। তারপর দীর্ঘ আন্দোলন বিক্ষোভের পর ভেঙেছিল নিয়মের বেড়াজাল।
আরও শুনুন: প্রেমে ভরসা আছে, মানুষে নেই! এআই প্রেমিকের হাত ধরেই ‘একলা ঘরে’র বাসিন্দা তরুণীরা
মোটামুটি ১৯৪০ সাল নাগাদ দিনে আট ঘণ্টা কাজের নিয়ম ফিরে আসে। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না কোথাও। এমন নিয়মই চালু হয় সর্বত্র। সেইসঙ্গে ছুটির ক্ষেত্রেও বছরের বেশ কিছু দিনকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। যদিও এরপর ২১ শতকে চিনে নতুন করে কাজের সময় বাড়িয়ে দিনে ১০ ঘণ্টা করে দেওয়া হয়। সেখানকার টেক কর্মীদের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য ছিল এই নিয়ম। মাঝে ২ ঘণ্টার বিরতি দিয়ে, সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা অবধি কাজের নিয়ম চালু হয় সে দেশে। তবে সবর্ত্র এই নিয়ম দেখা যেত না মোটেও। নেদারল্যান্ডসের কথাই ধরা যাক। সমীক্ষা বলছে সেখানকার কর্মীদের দিনে ৫.৮ ঘণ্টা কাজ করতে হত। আবার আমেরিকায় কর্মীরা কাজ করতেন দিনে ৬.৯ ঘণ্টা হিসাবে। যদিও এই পরিস্থিতিও আমূল বদলে যায় কোভিড পরিবর্তী সময়ে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের হাত ধরে আবারও ফিরে আসে দিনে ১১ ঘণ্টা কাজের হিড়িক। অর্থাৎ হিসাব বলছে, যন্ত্র, প্রযুক্তি যতই আসুক, মানুষের কাজের ঘণ্টা কিন্তু তেমন কমেনি। বরং বেড়েইছে।