মেট্রোর কামরায় ঘনিষ্ঠতাকে বাৎস্যায়ন হয়তো মন্দ চোখে দেখতেন না, তবে এ যুগের অনেকেই কিন্তু তেমন কাণ্ডকে সহজে মেনে নিতে নারাজ। সম্প্রতি দিল্লি মেট্রোর এক ভাইরাল ভিডিও সেই অপছন্দকেই ফের উসকে দিল। ‘কালচার শক’-এর আঘাতে সরগরম যে সোশাল মিডিয়া, সেই সোশাল মিডিয়াই আবার এই ভাইরাল কালচার-এর জনক, তার পৃষ্ঠপোষকও বটে।
ভিড়ের মধ্যে আলিঙ্গনে আপত্তি ছিল না কামসূত্র-রচয়িতা বাৎস্যায়নের। মন্দিরের ভিড় হোক কি উৎসবের ভিড়, সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানোর ফলে একে অপরের যে শরীরস্পর্শ ঘটছে, তার নাম তিনি দিয়েছিলেন উদ্ঘৃষ্টক আলিঙ্গন। এ যুগের মানুষ হলে হয়তো সেই ভিড়ের তালিকায় তিনি জুড়ে নিতেন মেট্রোর ভিড়ে ঠাসা কামরাকেও। মেট্রোর কামরায় ঘনিষ্ঠতাকে বাৎস্যায়ন হয়তো মন্দ চোখে দেখতেন না, তবে এ যুগের অনেকেই কিন্তু তেমন কাণ্ডকে সহজে মেনে নিতে নারাজ। সম্প্রতি দিল্লি মেট্রোর এক ভাইরাল ভিডিও সেই অপছন্দকেই ফের উসকে দিল। ভাইরাল ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, দিল্লির ভরা মেট্রোয় ‘রঙিন খেলায়’ মত্ত দুই তরুণী। পরনে সাদা পোশাক, সামনে আবির ছড়ানো। দুই তরুণী একে অপরের গালে দিচ্ছেন রঙের ছোঁয়া। স্পর্শ করছেন ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে। মেট্রোর কামরায় দুই তরুণীর এমন ঘনিষ্ঠতা দেখে যাত্রীরা কেউ বিরক্ত, কেউ অবাক, কেউ আবার মুখ ঢেকে হেসেছেন। ভিডিও ভাইরাল হতেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নেটিজেনদের একটা বড় অংশও। কেউ এ আচরণকে অশালীন বলে সুর চড়াচ্ছেন, আবার কেউ মনে করছেন এহেন আচরণ বিদেশি সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু এ দেশের সংস্কৃতিতে তা মোটেও মান্য নয়। তবে দু-একজন এমন কথাও বলছেন বটে, যে, প্রকাশ্য হিংসা যদি অশালীন না লাগে, ঘনিষ্ঠতাকে অশালীন বলে মনে হবে কেন! দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি প্রকাশ্যেও ঘনিষ্ঠ হন, তা অন্যায় হবে কেন!
আরও শুনুন:
মেয়েদের দাম কত! শাসক থেকে বিরোধী, সব পথ শেষে মিলে যায় একই প্রশ্নে?
এ ঘনিষ্ঠতাকে অনেকে ‘কালচার শক’ বলে দেগে দিচ্ছেন, সে কথা সত্যি। সেই শোকে যাঁরা আকুল হয়ে পড়েন, এক জনপ্রিয় গান থেকে ধার করে অনেকে আবার তাঁদের ‘কালচার কাকু’ নাম দিয়ে বসবেন, এও সত্যি। কিন্তু এই প্রেক্ষিতেই আসলে আরও একটি কথা ভেবে দেখার। এ ঘনিষ্ঠতা কি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ? যে ভালোবাসা ব্যাকরণ মানে না, সেই বাঁধনছাড়া ইচ্ছে? নাকি এও আদতে আরেক কালচার? যে সংস্কৃতির নাম ভাইরাল হওয়া? বলা বাহুল্য যে, আবেগের তারতম্য মাপার অধিকার কারও নেই, তা সংগতও নয়। কিন্তু ভিডিও থেকে দেখা যাচ্ছে, মেট্রোর মেঝেতে বসেই যে দুই তরুণী রং খেলায় মেতেছিলেন, তাঁরা আসলে রিল বানাচ্ছিলেন। ‘রামলীলা’ ছবির ‘অঙ্গ লগা দে’ গানের ছন্দেই যাবতীয় অঙ্গভঙ্গি করছিলেন দুজনে। তাঁদের ব্যক্তিগত আবেগ যাই হোক না কেন, রিল বানানোর নেপথ্যে যে ভিউয়ের তাড়না আছে, তাকে অস্বীকার করার জো নেই। ভিউয়ের বাড়বাড়ন্ত থেকে যে এই ডিজিটাল ক্রিয়েটররা আর্থিক লাভও করতে পারেন, সে কথাও জানা। অর্থাৎ ‘কালচার শক’-এর আঘাতে সরগরম যে সোশাল মিডিয়া, সেই সোশাল মিডিয়াই আবার এই ভাইরাল কালচার-এর জনক, তার পৃষ্ঠপোষকও বটে। যাঁরা এ ঘটনার সমালোচনায় মুখর, এই কনটেন্টের ভোক্তাও কি আসলে তাঁরাই নন?
আরও শুনুন:
অনুরাগ কাশ্যপের সময়ের দাম! ব্যাপারটা কি বড্ড ‘ঘাটিয়া’?
বাৎস্যায়ন যে প্রকাশ্য আলিঙ্গনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তাতে না ছিল ভিউ-এর হাতছানি, না ছিল টাকার ইশারা। কিন্তু মানুষের মনে যে নজর কাড়ার গোপন বাসনা রয়েছে, তার দরজা খুলে দিয়েছে সোশাল মিডিয়ার এই উপাদানগুলি। আর যা কিছু হয়েই থাকে, তা যে আলাদা করে নজর কাড়ে না, তাও সত্যি। তাই চরম অপ্রত্যাশিত, কি নাটুকে কোনও কাণ্ড করে তবেই নজর কাড়তে হবে, এমনটাই অভ্যাস করিয়ে দিয়েছে সোশাল মিডিয়া। সেখানে যদি কোনও কিছু নিয়ে ‘শক’ লাগারই থাকে, তবে দেশের সংস্কৃতি নয়, এই ভাইরাল সংস্কৃতি নিয়েই বোধহয় ভাবনা জরুরি। ব্যক্তিমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নিয়ে নিন্দেমন্দ কখনোই কাজের কথা নয়। তবে যা কিছু স্বতঃস্ফূর্ত, তা যদি দিনের শেষে নিয়ন আলোয় পণ্য হয়ে যায়, তবে সেই প্রবণতা নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে বইকি।