‘সেফ সিটি’ প্রকল্প মেনে, নারী সুরক্ষার উদ্দেশে দিল্লির অলিগলিতে সাড়ে ৯ হাজার সিসিটিভি বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ বিপদ রুখতে না পারলেও ঠিক কী ঘটেছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি ধরা পড়বে এই ক্যামেরায়। অন্ধকার পথে এই ‘ক্লোজড্ সার্কিট টেলিভিশন’ সহায় হবে জেনে আশায় বুক বাঁধলেন দিল্লির বাসিন্দারা। কিন্তু এরপরে দুই বছর পেরিয়েও দেখা মেলেনি একটিও সিসিটিভির!
অন্ধকার গলি হোক অথবা ছুটন্ত ট্রেনের জেনারেল কামরা, বন্ধুর বাড়ির হাউজপার্টি কিংবা অটোর সামনের সিট, এক মুহূর্তের জন্যও যেন অসতর্ক হতে পারে না মেয়েরা। কোনওরকম অযাচিত ছোঁয়াই যাতে সুবিধে না করতে পারে, সর্বক্ষণ নজর রাখতে হয় সেদিকে। তারপরেও বিপদ ঘটে। প্রায়শই খবরের কাগজ জুড়ে থাকে নারীহেনস্তার নানান কেচ্ছা। আর এ সমস্ত কিছুর মধ্যে সিসিটিভি তো নেহাতই অলঙ্কারমাত্র। সে বড়জোর ঘটনার প্রমাণটুকু ধরতে পারে, অভিযুক্তকে ধরার ক্ষমতা তো নেই তার! তবুও বিপদসঙ্কুল মুহূর্তে খানিক ইশ্বরকে খোঁজার মতোই আঁতিপাঁতি খোঁজে মেয়েদের চোখ, একটা সিসিটিভি অন্তত কোথাও থাকত যদি! অপরাধের প্রমাণ রয়ে যাচ্ছে ভেবেও কি পিছু হটত না অপরাধী? হয়তো খানিক তেমন ভাবনা থেকেই দিল্লিবাসী অপেক্ষা করে রয়েছেন সেই কয়েক হাজার সিসিটিভির, যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সরকারি তরফে।
এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার অবশ্য প্রশ্নই উঠত না, যদি না গাড়ির তলা পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাতেন বছর কুড়ির অঞ্জলি সিং। ২০২৩ সালের পয়লা জানুয়ারি বন্ধুর সঙ্গে পার্টি সেরে স্কুটি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন অঞ্জলি। আচমকা এসে ধাক্কা দেয় একটি বালেনো গাড়ি। বন্ধুটি ছিটকে পড়ে গেলেও, অঞ্জলির দেহ অদ্ভুতভাবে আটকে যায় গাড়ির নিচে। সে অবস্থাতেই পরের ১২ কিলোমিটার ছুটে যায় গাড়িটা। গাড়িতে বসা মদ্যপ ছেলেদের দল পরবর্তীকালে জেরায় জানায়, ভিতরে বসে নাকি এমন কিছু বুঝতেই পারেনি তারা! তবে তাদের কথাই সত্যি কি-না, সে কথা বুঝতে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যান ভারপ্রাপ্ত অফিসারেরা। কারণ, এ ঘটনার চাক্ষুষ প্রমাণ দেওয়ার মতো একজন মানুষকেও পাচ্ছিলেন না তাঁরা! আর তাই দীর্ঘ তদন্তের শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দিল্লির বেশ কিছু অন্ধকার রাস্তায় সিসিটিভি লাগানো হবে।
জেলা পুলিশ সমস্ত এলাকা যাচাই করে জানান, কম করে হলেও ৯,৯৪৫ সিসিটিভি প্রয়োজন পড়বে দিল্লির সমস্ত অন্ধকার গলিকে আলোকিত করে তুলতে। ‘সেফ সিটি’ প্রকল্প মেনে, রাজধানী শহর জুড়ে নজর রাখবে এই ‘চোখ’। বিপদ রুখতে না পারলেও ঠিক কী ঘটেছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি ধরা পড়বে সিসিটিভিতে। শাস্তি হতে পারে, তা জেনেই হয়তো সম্ভাব্য অপরাধীরা সতর্ক হবে। মদ্যপান করে গাড়ি চালানো অথবা ইভ-টিজিং-এর মতো কাজ থেকে বিরত রাখবে নিজেদের। সমস্ত অন্ধকার পথে সিসিটিভি সহায় হবে জেনে আশায় বুক বাঁধলেন দিল্লির বাসিন্দারা। যে মেয়েদের রোজকার চলার পথে ফাঁকা গলিপথ পেরোতেই হয়, তাঁরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলেন।
কিন্তু এরপরে পেরিয়ে গিয়েছে দুই বছর। সরকারি আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, এখনও নাকি ‘প্রসেসিং’ চলছে, যা শেষ হলে তবেই বসানো যাবে সিসিটিভি। নারী হেনস্তাও থমকে রয়েছে কি? সমীক্ষা কিন্তু তা বলছে না। আর এ সমস্যা কেবল দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ নেই। ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসে যখন তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুতে উত্তাল হয় কলকাতা শহর, তখন পর্যাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজের অভাবে বারে বারেই পিছিয়ে যেতে থাকে তদন্ত। রাতে কর্মরত ডাক্তার ও সহায়কদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করায় এই ঘটনা। যে দেশের এমন বিপুল সংখ্যক মেয়েকে কাজ অথবা অন্যান্য প্রয়োজনে রাতের বেলায় বেরোতেই হয়, সে দেশে সামান্য সিসিটিভির বসানোতে এতখানি গাফিলতি কেন, এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় শাসক ছাড়া অন্য কারও কাছেই নেই। নাগরিকরা সংশয়ে; দুই বছর কেন, কুড়ি বছর বাদেও কি এ অবস্থার পরিবর্তন আসবে? দিল্লি শহর তথা দেশ যেখানে নানা খাতে নতুন করে উন্নয়নের মুখ দেখছে, সেখানে সিসিটিভি বসানোর ক্ষেত্রে এই অবহেলা পরোক্ষে নারীসুরক্ষার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতাই প্রমাণ করে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো সুরক্ষাও যে অপরিহার্য, তা কি সরকার মনে করেন না তবে?