মানুষের শ্বাস নেওয়া যখন আক্ষরিক অর্থেই দিন দিন কঠিন হচ্ছে, সেই সময়েও সেই সংকট কি আদৌ ভাবাচ্ছে মানুষকে? নাকি মিম আর মজাতেই থমকে যাচ্ছে তার ভাবনার গতি? পরিবেশের বিপন্নতাও যদি কেবল মজার খোরাক হয়, তবে পরিবেশ রক্ষার কথায় গুরুত্ব দেবে কে?
বছর বছর শোনা যায়, ধোঁয়াশার ঠেলায় রাজধানী শহরটি প্রায় অদৃশ্য। বাতাসে শ্বাস নেওয়াই দুষ্কর, ফলে মানুষজনের পালাই পালাই দশা। কিন্তু পালাবে কোথায়? একা দিল্লিতে রক্ষে নেই, বাকি শহরগুলিও একরকম তারই দোসর। দূষণের হার কোথাও বাড়াবাড়ি বেশি, কোথাও হয়তো সামান্য কম, কিন্তু দূষণমুক্ত সজীব পরিবেশের দেখা কোথাওই মিলবে না। দিল্লির দূষণদাপট নিয়ে দেশজোড়া আলোচনার মধ্যেই কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের পরিসংখ্যান জানিয়েছে, বাংলা, এমনকি কলকাতাও দূষণের প্রতিযোগিতায় বিশেষ পিছিয়ে নেই। কিন্তু মানুষের শ্বাস নেওয়া যখন আক্ষরিক অর্থেই দিন দিন কঠিন হচ্ছে, সেই সময়েও সেই সংকট কি আদৌ ভাবাচ্ছে মানুষকে? নাকি মিম আর মজাতেই থমকে যাচ্ছে তার ভাবনার গতি?
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী, বাতাসের গুণগত মানের সূচক যদি শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকে, তবেই তা ভালো-র পর্যায়ে পড়ে। সেখানে দিল্লির বাতাসের গুণমান সূচক বর্তমানে প্রায় ৫০০ ছুঁইছুঁই। যা মানুষের বাঁচামরা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, যে পরিসংখ্যান দেখে রীতিমতো ভয় পাওয়ার কথা, দেখা যাচ্ছে তা নিয়েই মিমের স্রোত বয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। কেউ ‘কোই মিল গয়া’ ছবি থেকে মোটা কাচের চশমায় হৃতিক রোশনের ছবি দিচ্ছেন, সঙ্গে ক্যাপশন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছি না মা’। কেউ ‘তুম কাহাঁ/ ম্যায় ইঁহা’ গানের দৃশ্য তুলে এনেছেন, নায়িকার মুখ সেখানে ধোঁয়াশায় আড়াল হয়ে গিয়েছে। কোথাও আবার হ্যারি পটারে ম্যাজিক পাউডার উড়িয়ে ডায়াগন অ্যালিতে পৌঁছনোর ভিডিও, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছেন মলি উইজলি। আবার সারা পৃথিবী উড়ে বেড়ানো সুপারম্যানও নাকি দিল্লিতে ১০ মিনিট উড়েই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সিনেমা সিরিজের ছবি-ভিডিও দিয়ে এমনই নানারকম মিম ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। যাদের বিষয় একটিই, দিল্লির দূষণ। আর কেবল নেটিজেনরাই নাকি! এই অবস্থা নিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন রাষ্ট্রসংঘের প্রাক্তন আধিকারিক, লোকসভার সাংসদ শশী থারুরও। দিল্লির কি আর রাজধানী থাকার যোগ্যতা আছে আদৌ, প্রশ্ন তুলেছেন থারুর।
তবে কথা হল, দূষণ না মানে রাজনীতি, না মানে কাঁটাতার। দূষণ নিয়ে রাজনৈতিক ঠেলাঠেলি করা যেতে পারে ঠিকই, তবে দূষণের ঠেলা কিন্তু পোহাতে হয় সবাইকেই। এই যেমন ধরা যাক, চলতি মাসেই বায়ুদূষণের রেকর্ড গড়েছিল পাকিস্তান। ২৪ ঘণ্টায় লাহোরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ১৫ হাজার মানুষ। দিল্লিও কিন্তু এগোচ্ছে সেই একই পথে। এমনকি দিল্লির অবস্থা দেখে বাকি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকেও সতর্ক করেছে কেন্দ্র। মানুষের বিবেচনাহীন আগ্রাসী কাজকর্মের কারণেই যে বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে কথা নিয়ে কথা তো চলছেই। কেবল রাজ্যে বা দেশে নয়, দূষণের আক্রমণে গোটা বিশ্বেরই নাভিশ্বাস উঠছে। শিল্পবিপ্লবের আগে বিশ্বের যে গড় তাপমাত্রা ছিল, পরবর্তী কালে শিল্পের উৎপাদন ও বর্জ্য সংক্রান্ত দূষণে তা ক্রমে বাড়ছিল। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ঠিক হয়, শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রির নিচে আটকে রাখতে হবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে। কিন্তু বাকু-তে সাম্প্রতিক জলবায়ু সম্মেলনে ওয়ার্ল্ড মেটিয়োরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের রিপোর্ট বলছে, প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা প্রবল বিপদের সম্মুখীন। জানানো হয়েছে, এই বছরটি উষ্ণতম বছর হিসাবে রেকর্ড গড়তে চলেছে। অত্যধিক গরম, খামখেয়ালি বৃষ্টি, ঋতুর মর্জিবদল, ঘন ঘন শক্তিশালী সাইক্লোন, সুনামি, ভূমিধস- এ সবকিছুই মানুষকে ক্রমাগত অশনি সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সভ্যতার সে সংকট নিয়ে মানুষ ভাবছে কি?
শুধু ভারতের কথাই যদি ধরি, সেখানে সাম্প্রতিক কালেই কানওয়ার যাত্রার জন্য লক্ষ গাছ কেটে ফেলার কথা হয়েছে। তীব্র দাবদাহে যে উত্তরপ্রদেশে একের পর এক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, সেখানেই প্রকৃতির সবুজ আচ্ছাদনকে আরও অনেকটা ছিঁড়ে দিতে পিছপা হয়নি মানুষ বা সরকার। পরিবেশকর্মীরা কখনও নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে নেমেছেন, কখনও ওড়িশার কালাহান্ডি রায়গড় নিয়মগিরিতে বেদান্ত কোম্পানির জমি নেওয়ার বিরোধিতা করেছেন, কখনও মুম্বইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গাছ কেটে নগরায়ণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম হোতা গুরুদাস আগরওয়াল অনশনে মৃত্যুবরণই করেছেন, একইভাবে মৃত্যু হয়েছে নিগমানন্দ সরস্বতীরও। এই সাম্প্রতিক কালেই, লাদাখের পরিবেশ রক্ষার দাবিতে বারবার অনশনে বসেছেন সোনম ওয়াংচুক। এই সমস্ত কিছুই বারেবারে আমাদের বলেছে, নিজেদের বেঁচে থাকার জন্যই পরিবেশকে বাঁচানোর কথা ভাবা উচিত আমাদের। দিল্লিও সে কথাই বলছে। বছরের পর বছর। মিম আর মজার স্রোত ঠেলে, সেই কথা ভাবার অবস্থানে আমরা পৌঁছব কি?