মাটির তলায় চাপা পড়ে রয়েছে একশোরও বেশি মন্দির। পরীক্ষানিরীক্ষা করে এমনটাই অনুমান করেছেন গবেষকরা। কিন্তু সেইসব মন্দির উদ্ধার করা হবে কেমন করে? গোটা এলাকা জুড়েই যে ডাকাত দলের রাজত্ব। কী ঘটেছিল তারপর? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
জ্ঞানবাপী সার্ভের প্রসঙ্গে বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআই-এর নাম। বস্তুত দেশের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করাই এএসআই-এর কাজ। এর আগেও দেশের একাধিক পুরোনো মন্দির খুঁজে বের করার কাজে জড়িয়ে ছিল এই সংস্থা। এমনকি দস্যু অধ্যুষিত চম্বলেও কাজ করেছে তারা। আর সেখানে মন্দির খুঁজে পেতে সাহায্য মিলেছিল খোদ ডাকাতের সর্দারের কাছ থেকেই। কী ঘটেছিল ঠিক?
আরও শুনুন: ১০১ বছরেও ‘আত্মনির্ভর’, এই বয়সেও লাঠি ছাড়াই হাঁটেন গুজরাটের বৃদ্ধা
উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ— এই তিন রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে চম্বল উপত্যকা। যেখানকার ডাকাতদের কীর্তিকাহিনির কথা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু ইতিহাসের নথিপত্র ঘেঁটে বিশেষজ্ঞরা একসময় জানতে পেরেছিলেন, সেই অঞ্চলেই মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে শতাধিক মন্দির। অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যে গুর্জরা-প্রতিহরা বংশের রাজারা এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করেছিলেন। মনে করা হয়, ভূমিকম্পের জেরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল মন্দিরগুলি। কিন্তু খননকার্য চালিয়ে সেইসব মন্দির উদ্ধার করাও সহজ কথা নয়, কারণ গোটা এলাকা জুড়েই দুর্দান্ত ডাকাতদের রাজত্ব। ১৯২৪ সালে বটেশ্বরের শিব এবং বিষ্ণুর মন্দিরগুলিকে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করেছিল এএসআই, কিন্তু ডাকাতের ভয়ে সেখানে কাজ করতে রাজি হচ্ছিলেন না আধিকারিকেরা। বহু বছর পর এ কাজে এগিয়ে আসেন পুরাতত্ত্ববিদ কেকে মহম্মদ। তিনি ধর্মে মুসলিম। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ধর্মকে ছাপিয়ে বরাবরই গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর ইতিহাসবোধ। পাশাপাশি সাহসেরও কমতি ছিল না তাঁর। ২০০৪ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে চম্বলে খননকাজ শুরু করেন কেকে।
সে সময় ওই উপত্যকায় দলবল নিয়ে রাজত্ব করতেন দস্যু সর্দার নির্ভয় সিং গুজ্জর। ‘চম্বলের শেষ সিংহ’ বলেই এলাকায় নাম ছিল তাঁর। গুজ্জরের ভয়ে তখনও কাঁপত চম্বল। সেসময় বটেশ্বর মন্দির চত্বরে সবেমাত্র খননকাজ শুরু হয়েছে। কেকে-র কানে এসেছিল, ছদ্মবেশ ধরে মন্দির চত্বরে কাজ দেখে যাচ্ছেন গুজ্জর। এক সন্ধ্যায় তিনি দেখেন, একটি মন্দিরের বাইরে বসে ধূমপান করছেন একজন। কেকে নিজে ধর্মে হিন্দু নন, কিন্তু এ দৃশ্য দেখে তিনি প্রায় ধমকের সুরেই বলেছিলেন, মন্দির চত্বরে এমন কাজ করলে দেবতাকে অসম্মান করা হয়। তিনি অবশ্য জানতেনও না, কাকে এইভাবে তিরস্কার করে বসেছেন। খননকাজের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় এক বাসিন্দা তড়িঘড়ি তাঁকে সতর্ক করে দেন। আর তাতেই কেকে বুঝতে পারেন, এই ব্যক্তি আর কেউ নন, খোদ ‘চম্বলের শেষ সিংহ’ গুজ্জর। দীর্ঘ কথোপকথনে কেকে বোঝাতে পেরেছিলেন, তাঁরা পুলিশ নন। প্রাচীন ইতিহাস খোঁজা আর তাকে সংরক্ষণ করা ছাড়া আর কোনও মতলবও তাঁদের নেই।
আরও শুনুন: প্লেনে চড়তে গেলে ঢাকতে হবে শরীর! বিমানবন্দরে বিকিনি পরে বিপাকে তরুণী
আশ্চর্যের কথা হল, সেদিন সরকারি সংস্থাটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই ডাকাত সর্দারই। যে ডাকাতের ভয়ে খননকাজ চালানো যাচ্ছিল না, গুজ্জর নিজে সেখানে নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। শুধু একটিই শর্ত ছিল তাঁর। ওই এলাকায় একটি হনুমান মন্দির ছিল, ডাকাতিতে বেরোনোর আগে যেখানে প্রার্থনা করে যাওয়াই তাঁদের নিয়ম। গুজ্জরের শর্ত ছিল, সেই কাজে ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না, বদলে খননের সময় তিনিও কোনও বিঘ্ন ঘটাবেন না।
এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন এএসআই-এর ওই আধিকারিকও। খননকাজের আগে বটেশ্বর মন্দির চত্বরের ধ্বংসস্তূপে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মোটে দু’টি মন্দির। কিন্তু ডাকাত সর্দারের আশ্বাসের পর কাজ এগোয় নির্বিঘ্নে। শেষ পর্যন্ত চম্বলের ধ্বংসস্তূপ থেকে ৮০টি মন্দির উদ্ধার করা গিয়েছিল। আর এই ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে নাম জড়িয়ে ছিল চম্বলের ডাকাত সর্দার নির্ভয় সিং গুজ্জরের।