গোলাপি মেঘের মতো ক্যান্ডি ফ্লস বা হাওয়াই মিঠাই। ছোটবেলায় এই জিনিসটার উপরে লোভ ছিল না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বোধহয় কঠিন। কিন্তু বেশি মিষ্টি খেলে দাঁত খারাপ হয়ে যায়। ছোট থেকে এই আপ্তবাক্য শুনেই তো বড় হয় সবাই। তা কোনও দাঁতের ডাক্তার নিশ্চয়ই লজেন্স খাওয়াকে সমর্থন করবেন না! অথচ ছোটদের প্রিয় সেই বুড়ির চুল বা হাওয়াই মিঠাই জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে রয়েছে এক দন্তচিকিৎসকের অবদান। কীভাবে হাওয়াই মিঠাইয়ের খোঁজ পেল দুনিয়া? আজ শুনব সেই গল্পই।
অলস দুপুরে দূর থেকে ভেসে আসত ফেরিওয়ালার ডাক। দেখতে দেখতে সেই ঘণ্টার টুংটাং ঢুকে পড়ত বাড়ির গলিতে। হাতে একটা লাঠির মাথায় গাঁথা প্যাকেটবন্দি সব পেঁজা মেঘের টুকরো, কিংবা হাতগাড়িতে কাঁচ ঘেরা বাক্সে একরাশ গোলাপি-সাদা-হলুদ গোল মিষ্টি মণ্ড। ছোটবেলায় সেইসব দেখে বায়না করেনি এমন বাচ্চা বোধহয় একটাও ছিল না চৌহদ্দিতে। কোথাও নাম ‘বুড়ির চুল’, তো কোথাও ‘হাওয়াই মিঠাই’। মেলায় ভিড় জমে যেত স্টলে। ঢাউস একটা যন্ত্রের গায়ে কাঠি ছোঁয়াতেই বেরিয়ে আসছে নানা রঙের সব মেঘ। যেন ম্যাজিক। ‘ক্যান্ডি ফ্লস’ বা ‘কটন ক্যান্ডি’ কিংবা ‘স্পুন সুগার’- এসব নাম তো শেখা আরও পরে। তবে মফস্বলে ছোটবেলা বলতে ওই রংবেরঙের ‘বুড়ির চুল’।
মিষ্টিজাতীয় জিনিস বেশি খাওয়া দাঁতের পক্ষে মোটেও কল্যাণকর নয়। ছোটবেলায় এই সতর্কবাণী শুনতে কারই বা ভাল লাগত বলুন! এদিকে দাঁতের ডাক্তার মানেই তো ভয়। লজেন্স-মিষ্টি-চকলেটে বারণ। তবে এই ক্যান্ডি ফ্লস বা হাওয়াই মিঠাই তৈরির গল্পটা শুনলে কিন্তু বেশ অবাকই হবেন। দাঁতের ডাক্তারেরা তো মিষ্টি খেতে না-ই করে থাকেন সাধারণত। কিন্তু ছোটদের হাতে প্রিয় মিষ্টি তুলে দেন, এমন দাঁতের ডাক্তারের কথা শুনেছেন কখনও? তবে উনিশ শতকে এমনই একজন ডাক্তার থাকতেন আমেরিকার টেনিসিতে। হাওয়াই মিঠাইকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে রয়েছে তাঁরই অবদান।
আরও শুনুন: কাঁটাচামচ ব্যবহার করলে অভিশাপ দেবেন দেবতারা, কেন ছিল এমন বিশ্বাস?
সত্যি বলতে, ইটালীয়রাই প্রথম চিনির রস জ্বাল দিয়ে দিয়ে তার থেকে শক্ত, মুচমুচে এক ধরণের সুতোর মতো মিষ্টি বানাতে শিখেছিল। তবে তা ছিল হাওয়াই মিঠাইয়ের একেবারে প্রথম ধাপ। আর গোটাটা ছিল বেশ পরিশ্রমের ব্যাপার। সঙ্গে খরচসাপেক্ষও। ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্স থেকে ভেনিসে এসেছিলেন তৃতীয় হেনরি। তাঁর জন্য নাকি সেসময় বিশেষ স্পুন-সুগার ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। স্পুন সুগার দিয়ে তৈরি মোট ১,২৮৬টি খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল তাঁর সামনে। যার মধ্যে ছিল একটি টেবিলক্লথও, যা তৈরি হয়েছিল ওই চিনি জ্বাল দিয়ে দিয়ে।
১৮৯৯ সালের পর থেকে আমেরিকায় জনপ্রিয় হতে শুরু করল এই ক্যান্ডি ফ্লস বা হাওয়াই মিঠাই। তার পিছনে ছিল সেই দন্তচিকিৎসকের অবদান। উইলিয়াম জে মরিসন নামে ওই দাঁতের ডাক্তার তখন সবে সবে ইউনিভার্সিটি অব টেনিসি ডেন্টাল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। দাঁতের স্বাস্থ্য ও লজেন্স, এই দুটি ব্যাপারে বরাবরই বেশ আগ্রহ ছিল মরিসনের। এরই মধ্যেই জন সি ওয়ারটন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। ওয়ারটন ছিলেন পেশায় ময়রা। তাঁর সঙ্গে মিলে মরিসন বানিয়ে ফেললেন একটা লজেন্স বানানোর মেশিন। যাতে সুগার ক্যান্ডি বানানোর পরিশ্রম গেল কমে। কোনও রকম কষ্ট ছাড়াই পেঁজা তুলোর মতো ওই মিষ্টি তৈরি হতে লাগল অনায়াসে। দুজনে মিলে ওই মিষ্টির নাম রাখলেন ‘ফেয়ারি ফ্লস’। কমদিনের মধ্যেই ওই ইলেকট্রিক চালিত ক্যান্ডি মেশিনের পেটেন্ট পেয়ে গেলেন দুজনে।
আরও শুনুন: সুখের খোঁজে গোটা একটা মিউজিয়াম! বিশ্বের কোথায় এমন সংগ্রহশালা আছে জানেন?
১৯০৪ সালে লুইসিয়ানায় একটি মেলা বসেছিল। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন সেই মেলায়। সেখানেই নিজেদের ওই মেশিন নিয়ে হাজির হন মরিসন ও ওয়ারটন। অবাক কাণ্ড, মেলার প্রথম দিনেই ৬৮ হাজার ৬৫৫ বাক্স হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল হটকেকের মতো। একেকটি হাওয়াই মিঠাইয়ের দাম ছিল ২৫ সেন্ট করে। সে সময় দাঁড়িয়ে অঙ্কটা কিন্তু ছিল বেশ চমকে দেওয়ার মতোই।
সেখান থেকে ক্রমেই গোটা বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয়তা পায় এই হাওয়াই মিঠাই। ১৯২০ সাল নাগাদ ‘কটন ক্যান্ডি’ নামে জনপ্রিয় হতে থাকে এই বিশেষ খাবারটি। অস্ট্রেলিয়ায় আবার ‘ফেয়ারি’ ফ্লস বলারই বেশি চল। এদিকে ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড বা অন্যান্য দেশগুলিতে এই খাবারটি বেশি পরিচিত ‘ক্যান্ডি ফ্লস’ নামে। নানা দেশে নানা নাম এই মজার খাবারটির। আর সেটাই বোধহয় ইউএসপি এই মজার মিষ্টির। ছোটরা অনেক কিছুর সঙ্গেই মিল খুঁজে পায় এর, আর সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন নতুন ডাকনাম। কোথাও ‘হাওয়াই মিঠাই’ তো, কোথাও ‘বুড়ির চুল’। নাম যাই হোক, যুগ বদলালেও আজও ছোটদের কাছে এই ম্যাজিক-মিষ্টির আবেদন কিন্তু কমেনি একচুলও।