হেড আফিসের এক বড়বাবুর কথা আমাদের জানিয়েছিলেন সুকুমার রায়। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে যাঁর কিনা আচমকাই মনে হয়েছিল যে তাঁর গোঁফজোড়া চুরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জানেন কি, পৃথিবীতে এমন মানুষেরও দেখা মেলে, যাঁরা এই বড়বাবুরই দলে? কেবল গোঁফ কেন, হাত পা মাথা এমন এক বা একাধিক অঙ্গকেই মাঝে মাঝে খুঁজে পান না তাঁরা। এমনকি কখনও কখনও প্রাণ হারিয়ে ফেলেছেন বলেও ভাবেন ওই ব্যক্তিরা। কেন জানেন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রাতের খাবার বানাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধা মহিলা। হঠাৎই শরীরের একপাশ যেন অবশ হয়ে গেল তাঁর। কিছুক্ষণ পর সংবিৎ ফিরে পেতেই মেয়েকে বললেন তাঁর পোশাক পালটে দিতে। কেন-না, ওই বৃদ্ধার মনে হয়েছিল মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সুতরাং এবার কবর দেওয়ার পালা। এদিকে মেয়ের তো আকাশ থেকে পড়ার দশা। যেন সেই ‘গোঁফ চুরি’ কবিতার মতোই, সকলে বারবার বৃদ্ধাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তিনি দিব্যি বেঁচেবর্তেই রয়েছেন। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। অবশেষে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয় বৃদ্ধার পরিবার। চার্লস বনেট নামের সেই চিকিৎসকই প্রথম, যিনি এহেন কেসের সন্ধান পেয়েছিলেন। আমেরিকার বাসিন্দা ওই বৃদ্ধার এমন ধারণা যে আসলে একরকম রোগের উপসর্গ, সে কথাও বুঝতে পেরেছিলেন বনেট।
আরও শুনুন: গড় আয়ু ১০০ বছর, তবুও অটুট যৌনজীবন! বিস্ময় দ্বীপে বাস করলে সেরে যায় অসুখও!
বনেট যখন ওই রোগীকে দেখেন, সেটা ১৭৮৮ সাল। কিন্তু এই সমস্যাটিকে পৃথক কোনও রোগ হিসেবে চিহ্নিত করতে করতে আরও অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছিল। তার প্রধান কারণ, এই রোগটি অত্যন্ত দুর্লভ। ডাঃ বনেটের পর আবার যিনি এহেন রোগী পেয়েছিলেন বলে জানান, তিনি ফরাসি চিকিৎসক জুল কোটার্ড। ১৮৮০ সালে ডাঃ বনেটের মতোই একটি রোগী দেখার সুযোগ পান ডাঃ কোটার্ড। তাঁর রোগী ছিলেন ৪৩ বছরের এক মহিলা। তিনি ডাক্তারের কাছে এসে জানান- তার মগজ, স্নায়ু, বুক, পেট কিচ্ছু নেই। রয়েছে কেবল পচতে থাকা দেহে চামড়া আর হাড়। এমনকি তাঁর দাবি ছিল, তার পক্ষে স্বাভাবিক মৃত্যু দ্বিতীয়বার সম্ভব নয়, তাই একমাত্র উপায় তাঁর দেহটিকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা। সেই সময়েই ডাঃ কোটার্ড এই রোগের নাম দেন, ‘নেতিবাচক বিশ্বাসে’র রোগ’। আর তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নামের সঙ্গে জুড়েই এই রোগের নাম হয়ে দাঁড়ায় কোটার্ড সিনড্রোম।
আরও শুনুন: তাজমহল তো বটেই, ৫৪৫ জন সদস্য-সহ পার্লামেন্টটিকেও বেচে দিয়েছিলেন তিনি! জানেন কে এই ব্যক্তি?
এখনও পর্যন্ত মোটামুটি শ-দুয়েক ব্যক্তির মধ্যে এই অদ্ভুত রোগ দেখা গিয়েছে। তাঁরা কেউ নিজেদের সম্পূর্ণ মৃত বলেই ভাবেন। কেউ কেউ মনে করেন শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ নষ্ট হয়ে গিয়েছে তাঁদের। ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ক্ষতি করারও চেষ্টা করেন অনেকে। চেষ্টা করেন নিজের শেষকৃত্য করারও। সব মিলিয়ে একপ্রকার মানসিক রোগ হিসেবেই কোটার্ড সিনড্রোমকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু দুর্লভ রোগ বলেই এই রোগ নিয়ে বিশদ গবেষণা করা সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষেও। আর সেই কারণেই, কোটার্ড সিনড্রোমের নির্দিষ্ট চিকিৎসাও এখনও পর্যন্ত নেই বললেই চলে।