কমিক্সকে আপাতভাবে আমরা শিশুপাঠ্য গণ্ডিতেই আটকে রাখি। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে যে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া যায়, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন কমিক্স কম্যান্ডোরা। কারা তাঁরা? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
কারও কাজ ঘাড়ে করে ইট বয়ে নিয়ে যাওয়া। কারও কাজ দু-তিন বাড়ি কাজ করা। কেউ আবার ইতিমধ্যেই বিয়ে করে মা হতে বাধ্য হয়েছে। কারও বয়স ছয় সাত, কারও আবার দশ-বারো, খুব বেশি হলে চোদ্দ। স্কুল, খাতা-পেন-রং-পেনসিলের দুনিয়া ছেড়ে ওরা সবাই কোনও না কোনোভাবে পা রেখেছে খেটে খাওয়ার কঠোর বাস্তবে। ওরা সকলেই শ্রমিক। এ দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির মধ্যে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতগুলি আজও দগদগে। আসামেও রয়েছে তার প্রকোপ। আর সেই শিশুশ্রম রোখার লড়াইয়েই এবার মাঠে নেমেছেন ‘কমিকস কম্যান্ডো’রা।
কমিক্স-কম্যান্ডো। নামটা শুনেই একটু থমকে যেতে হয় তাই না? কম্যান্ডো মানেই প্রতিরক্ষা, কম্যান্ডো মানেই হ্যাট-বুট-স্যুট পরা কোনও সেনা- এমন ছবিই আমাদের মাথায় আসে। তাই তো? কিন্তু এই কম্যান্ডোরা হল কমিক্স আঁকার দলবল। অস্ত্রশস্ত্র বলতে তাদের সঙ্গে আছে ছবি আঁকার অঢেল সামগ্রী। তাহলে গল্পটা শুরু থেকেই বলা যাক। না না গল্প নয়। একেবারে সত্যি কথা।
আরও শুনুন: সারাদিন অনাহারে ১৫ কোটি শিশু, অথচ বিশ্বজুড়ে নষ্ট হয় ১০৫০ কোটি টন খাবার
পশ্চিম আসামের গোয়ালপাড়া জেলা। সেখানকার বোদাহাপুর উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানেই এই নিয়ে সম্প্রতি ঘটে গেল এক বৃহৎ কর্মশালা। স্কুলছুট হয়ে যাওয়া শিশুশ্রমের বিষয়টিই ছিল কমিক্স আঁকার বিষয়। হ্যাঁ। এমনই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন সেন্টার ফর মাইক্রোফিনান্সের প্রতিনিধি কুলদীপ দাস। সেন্টার ফর মাইক্রোফিনান্সের ছেলেমেয়েরা সম্প্রতি দল বেঁধে হাজির হয়েছিলো গোয়ালপাড়া জেলার বালিজান ব্লকের বোদাহাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। তাঁরা শুরুতেই তিরিশজন স্থানীয় ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি দল তৈরি করেন। তাঁদের লক্ষ্যই ছিল ছবি আঁকার ছুতোয় এক বিরাট সত্যের মুখোমুখি তাদের দাঁড় করানো। আর তা হল স্কুলছুট শিশুদের শিশুশ্রমিক হওয়ার বা বাল্যবিবাহের কবলে পড়া থেকে রক্ষা করা। গোয়ালপাড়া জেলার গেন্ডাবাড়ি গ্রামের এক বাসিন্দা এই খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, গ্রামের একেবারে নিচু তলার মানুষরা কীভাবে তাদের সন্তানদের ইঁট-ভাটায় বা অন্য লোকের খামারে কাজ করতে বাধ্য করে। তিনি যে কমিকস এঁকেছেন, তা কিন্তু পুরোপুরি শিশু নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই।
বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা নিতান্ত শৈশব থেকেই দোকান, ইটভাটা, কয়লাখনির মতো বিভিন্ন কঠিন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। কয়েক জন কাজের ফাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও অধিকাংশজনের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি কাজে নেমে যেতে বাধ্য হয় অনেকেই। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই! একরত্তি মেয়েকে বিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ। আর এই স্কুলছুট কিম্বা নাবালিকা বিবাহের হাত ধরেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে শিশুশ্রমের শুরুয়াত ঘটে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ২০২৩ সালেই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একটি অভিযান শুরু করেছিলেন। এমনকী ২০২৬ সালের মধ্যে সমস্ত সামাজিক কুপ্রথাগুলি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন৷ সর্বভারতীয় ভারতীয় শিশু সুরক্ষা সমীক্ষার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, কড়া হাতে রাশ টানার দরুন আসামের রাজ্যগুলিতে বাল্যবিবাহ নাকি ৮১ শতাংশ কমেছে। কিন্তু কর্মকর্তারা বলছেন বাল্যবিবাহের শিকড় উপড়ে ফেলা যায়নি এখনও, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে। বলা বাহুল্য নিরক্ষরতা এবং দারিদ্র্যই এর মূল কারণ।
আরও শুনুন: রংচঙে ছবি নয়, আঁকার খাতা জুড়ে নেমে এসেছে বিধ্বস্ত পৃথিবী! মন ভালো নেই শিশুদেরও
তবে এই এতরকম হতাশার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে কমিক্স-কম্যান্ডোরা। কমিক্সকে আপাতভাবে আমরা শিশুপাঠ্য গণ্ডিতেই আটকে রাখি। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে যে এমন গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া যায়, তাই বুঝিয়ে দিলেন কমিক্স কম্যান্ডোরা। সত্যি বলতে যে কোনও জনপ্রিয় বিষয়ের মাধ্যমেই অতিদ্রুত মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাওয়া যায়। আর এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করেই কমিক্স কম্যান্ডো চেক-মেট করতে চেয়েছে। শেষমেশ ফলাফল যাই হোক না কেন, এই অসামান্য উদ্যোগটির প্রতি সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই।