রঙের উৎসব। রঙিন চতুর্দিক। অথচ অনেকেরই চোখে ধরা পড়ে না সব রং। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বিশেষ একটি রং দেখতে পেতেন না বলে জানা যায়। চেতনার রং আর ভাবের রঙেই তখন ধরা পড়ে রঙের অন্য তাৎপর্য। লিখলেন, রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
রং-এর বৈভবেই সাজে মানুষের জীবন। কিন্তু রঙের সঙ্গে যাদের বরাবরের আড়ি, তাদের জীবনটা কেমন? বড় বেরঙিন, কেবল সাদা-কালোর মনোক্রোম? নাকি সেই ধূসর রঙের নাম তারাই ‘পথ চাওয়া’ দেয়, কাছাকাছি কোনও রং না পেয়েই যাদের রাঙিয়ে তোলা হয় না আর কিছুই? যে রং নেই, তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আর কাল গুনে থেকে যাওয়া হয়তো লেগে থাকে সেই রংহীন রঙে। অপেক্ষার শরীরে রং চড়ায় সেই চেয়ে থাকা। আর সে চাওয়ার রং নিয়েই হয়তো কোনও এক ফাল্গুন দিন এসে দাঁড়ায় সে মানুষের চেতনার গোপনে। নিজের চৈতন্যেই হয়তো তখন গড়ে ওঠে সেই না-পাওয়ার সঙ্গে যোগাযোগের এক সেতু। বর্ণান্ধতার না-রং তখন পালটে যায় বর্ণালিতে।
বিজ্ঞানের পরিভাষায় অবশ্য বর্ণান্ধতা এক অসুখের স্পেকট্রাম। যা একেবারে বিরলও নয়। অল্পবিস্তর রংহীনতায় বাস করেন অনেকেই। প্রতি ২০০ জন মহিলার মধ্যে একজন এবং প্রতি ১২ জন পুরুষের মধ্যে একজন ‘কালার ভিশন ডেফিসিয়েন্সি’-তে আক্রান্ত হন, পরিসংখ্যানের দাবি এমনটাই। তবে রং হারানোর মাত্রা সকলের সমান হয় না। ডিউটেরানোমালিয়ায় আক্রান্তরা গাঢ় লাল ও সবুজ রংকে হালকা দেখেন, প্রোটানোপিয়ায় আক্রান্তরা আবার লাল এবং সবুজ রং দেখতেই পান না, এদিকে ট্রিটানোপিয়ায় আক্রান্ত হলে সব কিছুই লাল ও সবুজ রঙে ছোপানো বলে মনে হয়। আর মোনোক্রোম্যাসি হল সম্পূর্ণ ভাবে বর্ণান্ধতা, অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চোখে গোটা দুনিয়াটা সাদা-কালো। অর্থাৎ ঘুরেফিরে এসে দাঁড়ানো গেল সেই পুরনো জেব্রা ক্রসিংয়ে, যেখান থেকে কথা শুরু হয়েছিল। আসলে কথারা তো না মানে বিজ্ঞানের থিয়োরি, না মানে কেবল ব্যাকরণিক উপক্রমণিকা। এসবের বাইরে গিয়ে কথারা যে রং আর রং হারানোকে চেনে, তার বর্ণমালা আলাদা। সে বর্ণমালাকে চিনতে চেয়ে কেউ হাতড়ে বেড়ান- ‘তোমার কথার রং কি লাল/ হলুদ সবুজ হালকা নীল/ বুঝি বা শুভ্র শরৎকাল/ তোমার কথার শঙ্খচিল!’ আবার পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পর, হাজার বছরের পথ পেরিয়ে এসে তার মুখোমুখি হন কেউ, যে রঙের নাম হয় অন্ধকার।
আর এখানেই বোঝা যায়, বর্ণ আর বর্ণান্ধতা দুয়েরই গায়ে লেগে রয়েছে অর্থের বর্ণমালাও। রংকে যেমন মানুষ নিজের মতো করে চেনে, তেমন করেই রং না থাকার ব্যঞ্জনাও তার নিজস্ব। কেউ সেই না-থাকার নাম অন্ধকার দিলেও, নীড়ের মতো সে অন্ধকারের বুকে পাখির ঘরে ফেরার ডাক। আবার কারও কাছে সে অন্ধকার অস্থির, নিজের মনের ঘরে ফেরার সম্ভাবনাও যেখানে কালো রঙে ঢাকা। সত্যজিতের ‘বর্ণান্ধ’ গল্পে যেমন সেই রংহীন শিল্পীর কাছে গোটা পৃথিবীটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছাতা-পড়া ফ্যাকাশে। হরেক রকমের একঘেয়ে ধূসর ছাড়া আর কোত্থাও কোনও রং সে খুঁজে পায়নি। আর সেইসঙ্গে খুঁজে পায়নি জীবনের আর কোনও মানেও। আবার জীবনের ডানায় ভর করেই কোনও শিল্পী হারানো রঙের কাছেও তো ফেরেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেমনটা বলছেন রানী চন্দ, “গুরুদেব প্রায়ই বলতেন, তিনি রংকানা, বিশেষ করে লাল রংটা নাকি তাঁর চোখেই পড়ে না”। অথচ যে লাল রং তাঁর চোখে পড়ে না বলে শোনা যায়, বারেবারে তিনি সেই রঙেরই নাগাল ধরেছেন, কখনও আঁকায় কখনও লেখায়। লেখার সঙ্গে যে আপাতভাবে রঙের যোগ নেই, ছবি আঁকা আর শব্দের লেখা যে দুই মেরুর বাসিন্দা, এ কথা তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। কেননা ‘কাদম্বরী চিত্র’-এ তিনি নিজেই তো বলেন, “রং ফলাইতে কবির কী আনন্দ।… সে রং শুধু চিত্রপটের রং নহে, তাহাতে কবিত্বের রং, ভাবের রং আছে। অর্থাৎ কোনও জিনিসের কী রং শুধু সেই বর্ণনামাত্র নহে, তাহার মধ্যে হৃদয়ের অংশ আছে”। শিল্পীর হৃদয়ের অংশ-ই আসলে সেই অলক্ষ রং, তা শিল্পের অকারণের সুখকে রাঙিয়ে তোলে। এই বোধ বা চেতনার জায়গা থেকে রংকে দেখেন বলেই, বর্ণান্ধতাকে হেলায় উড়িয়ে রাঙা হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের ছবির ভুবন।
আসলে রঙের গায়ে যেটুকু নামপরিচয় লেগে থাকে, তার সঙ্গে নিজের মতো অর্থ জুড়েই কালার প্যালেট বানায় মানুষ। যা কোথাও ছিল না, অর্থ জুড়ে জুড়ে তাকে সত্যি করে তোলে। সেই মর্মে লাগা রংকে গোপন করার সাধ্য নেই বর্ণান্ধতারও। চেতনার রঙেই যখন রঙের নামাবলি তৈরি হয়, সেখানে রং-ও হয়ে ওঠে আদতে একটি ধারণা। আর এইখানেই, আরেকরকম অর্থের চাদর গায়ে জড়িয়ে নেয় বর্ণান্ধতাও। আদতে কি আমরা সব রং দেখতে পাই, সবসময়? নাকি নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী, যা দেখতে চাই সেই রংগুলোকেই বেছে নিই? নবনীতা দেবসেন যেমন বলেছিলেন, “আমরা সবাই বুকের মধ্যে এক-একটা প্রিয় রং পুষে রাখি। সেই পোষা রঙের সঙ্গেই আমাদের গল্পগাছা, হাসিকান্না। হঠাৎ সেখানে অচেনা রঙের হামলা হলে আমরা রংকানা হয়ে যাব না?” যারা কোনও একটি রং মনে পুষে রাখে, তারা নাহয় অন্য রঙের আচমকা অনুপ্রবেশে রং গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু যারা রংকানা হতেই চায়? যারা নিজেদের গায়ে কোনও রঙের তকমা লাগাতেই ভয় পেয়েছে বরাবর, কিংবা কোনও রংকে নিজের বলে নির্বাচন করতে চায়ই নি? নিজের রং বেছে নেওয়া তো আসলে সিদ্ধান্তের মতো, পক্ষ নেওয়ার মতো। যে সেই স্পষ্টতাকে এড়াতে চেয়েই সই পাতিয়েছে বর্ণান্ধতার সঙ্গে? একেকটি রঙের একেকরকম ভালো-খারাপে সে পক্ষ নেয়নি, কাউকে চিনতে দেয়নি নিজের আসল রংও। তার কাছে কোনও রঙের আলাদা করে গুরুত্ব নেই বলেই তো সে সবার রঙেই রং মেশাতে পারে। বড় বেরঙিন আজকালে সেই বর্ণান্ধতাই হয়তো সতর্কতার রং। কে জানে, বাকি যা কিছু অসাবধানী, তা হয়তো নিছকই ‘রংকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’।