যত পর্যটক, তত অর্থ। লোকের টানেই লক্ষ্মীলাভ পর্যটনকেন্দ্রগুলোর। তবে, তার জেরে কি নির্দিষ্ট কোনও জায়গার সৌন্দর্য আর পরিবেশের দফা রফা হচ্ছে। কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
প্রকৃতির ভাঁড়ারে অফুরান সৌন্দর্য। তার টানেই যেন বাড়ি থেকে পালিয়ে বেরিয়ে পড়া; কংক্রিটের শহর থেকে দিন কয়েকের জন্য মুক্তি। আসলে কেজো ব্যস্ততা আমাদের এমন দমবন্ধ করে রাখে যে, মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে মানুষ ছুটে যায় দূর-দূরান্তে। এ-রেওয়াজ তো নতুন নয়। তবে, সেই ভিড়ে কি চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে পর্যটন ডেস্টিনেশনগুলোই! এই সম্ভাবনাই ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে। আশঙ্কাও জাগাচ্ছে।
সম্প্রতি ভ্রমণপ্রিয় বহু মানুষের কাছেই আতঙ্কের অন্য নাম হয়ে এই ‘ওভারট্যুরিজম’। জনপ্রিয় জায়গাগুলো ভরে যাচ্ছে অগুনতি মানুষে। শান্ত প্রকৃতি কোলাহলে ক্লান্ত। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ছে নির্দিষ্ট এলাকার বাস্তুতন্ত্রে। পর্যটকদের এই অতিরিক্ত ভিড়ের নির্দিষ্ট কারণ আছে। কোভিডের সময় পর্যটন ইন্ডাস্ট্রি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মহামারী পেরিয়ে এসে,পর্যটক টানার ক্ষেত্রে তাই নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অর্থনীতি চাঙ্গা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। দেখা গেল, আগে যে বিমানের ভাড়া সাধ্যের বাইরে ছিল, এখন তা অনেকটাই নাগালের মধ্যে। এছাড়া ট্যুরের ক্ষেত্রে এমন অনেক প্যাকেজের অফার মিলছে সংস্থাগুলির থেকে, যা মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে। তা ছাড়া করোনাকালের আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায়ও ছিল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া। নানা কারণ মিলেমিশেই পর্যটনক্ষেত্রে আবার দেখা গেল জনজোয়ার। তাতে অর্থনীতি চাঙ্গা হল ঠিকই, তবে এই ভিড় একই সঙ্গে ডেকে আনল বিপদও।
আরও শুনুন: একরাত কাটানোর খরচ ৮৩ লাখ! বিশ্বের সবথেকে দামি হোটেল চেনেন?
বিপদের মূলসূত্রটি হল, নির্দিষ্ট কোনও কোনও জায়গায় অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ। তাতে একটি এলাকার যে নির্দিষ্ট বিন্যাস থাকে, তাই-ই আচমকা নষ্ট হচ্ছে। ধরা যাক, কোনও পাহাড়ি এলাকা। সেখানে যদি একই সময়ে বহু মানুষ গিয়ে হাজির হন, তাহলে পাহাড়ের ছবিটিই যেন আর আগের মতো থাকে না। বরং তা হয়ে যাচ্ছে, পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে শহরের ছোট সংস্করণ। একই কথা প্রযোজ্য সমুদ্রের ক্ষেত্রেও। পর্যটকদের সুবিধার কথা সবার আগে মাথায় রাখতে হয়। তার দরুণ কোনও নির্দিষ্ট এলাকার স্বাভাবিক জনজীবনও ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের মতো দেশে এলাকাভিত্তিতে প্রথা ইত্যাদি বদলে যায়। পর্যটকদের চাপে অনেক সময় সেসবও ব্যাহত হচ্ছে। অনেক পর্যটক একই সময়ে হাজির হওয়ার ফলে জলের ব্যবহার বাড়ছে, যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার জল ব্যবহারের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। অতিরিক্ত গাড়ির চাপ, বা জঙ্গল এলাকায় অতিরিক্ত মানুষ একসঙ্গে থাকার ফলে, প্রকৃতির যে স্বাভাবিকতা হারিয়ে যেতে বসেছে। অর্থাৎ একদিকে যেমন অর্থ আসছে, অন্যদিকে অনর্থের সম্ভাবনাও কম নয়। এই সংকটের ভিতরই পড়েছে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলো।
তবে, এই ভিড়ের চাপ বা ওভারট্যুরিজমের সবথেকে ক্ষতিকর দিকটি হল দূষণ। এমনিতেই পরিবেশ দূষণ এই মুহূর্তে সভ্যতার সংকট। কীভাবে তা অতিক্রম করা যায়, তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। সে চিন্তা যেমন রাষ্ট্রের, তেমন প্রতিটি মানুষেরই। আর তাই প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য পাতিয়ে কীভাবে আধুনিক জীবনকে সাজানো যায়, তা চিন্তা করছেন অনেকেই। এবং সেই ধরনের যাপনপদ্ধতিও বেছে নিচ্ছে। সেখানেই মস্ত প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে এই ওভারট্যুরিজম। পর্যটকদের উপচানো ভিড় প্রকৃতিকে দূষিত করছে মারাত্মক ভাবে। যা থেকে পরিত্রাণের উপায় তাই নেই বললেই চলে!
কী এই সমস্যার সমাধান? অনেকেই বলছেন, জনপ্রিয় ডেস্টিনেশনগুলো এড়িয়ে কম পরিচিত কোনও জায়গায় যাওয়াই আসলে এই অসুবিধা দূর করতে পারে। অর্থাৎ যাকে বলে অফবিট ডেস্টিনেশন, যেখানে এখনও বেশি মানুষ যান না সচরাচর। ফলে, ভিড়ের অস্বাভাবিকতা এখনও নেই। তবে প্রকৃতির সান্নিধ্য আছে। যদি পর্যটকসংখ্যা নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় না বেড়ে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তাতে দুটো লাভ হয়। এক, কোনও একটি জায়গা ভিড়ের চাপে ওষ্ঠাগত প্রাণ হয় না। পাশাপাশি অন্য জায়গাগুলোর অর্থনীতিও খানিক সচল থাকে। তবে, বর্তমানে অফবিট ডেস্টিনেশনও যেন মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠেছে। ফলে, ভবিষ্যতে এই ওভারট্যুরিজম যে চূড়ান্ত মাথাব্যথার কারণ হবে, তা বলাই যায়।