তুষারদেশ আন্টার্কটিকা। ধবধবে সাদা বরফের চাদরে ঢাকা হিমবাহের মাঝখানে নেমে আসে রক্তের ধারা। দেখলে চমকে উঠতে হয় বৈকি। হিমবাহের মাঝখানে একটি অংশ থেকে নেমে আসছে টকটকে লাল রক্তের ধারা।তবে শুধু ওটুকু অংশ জুড়েই লালের ছায়া। বাকি অংশ কিন্তু যেমন বরফ-সাদা, তেমনই। কীভাবে ওই অংশটুকুর জল অমন লাল হল? শুধুই কি প্রকৃতির খেয়াল না এর পিছনেও রয়েছে কোনও বিজ্ঞান? আসুন, শুনে নিন।
হিমবাহের বুক চিরে নেমে আসছে টকটকে লাল শোনিত স্রোত। বহুদিন ধরেই আন্টার্কটিকার এই রক্তাক্ত ঝরনা ছিল একটা রহস্য। কী ভাবে অত সব জমাট বরফের মধ্যে থেকে নেমে আসে রক্তের মত লাল ঝরনা! দেখলে মনে হবে, সত্যিই বোধহয় হিমবাহের বুকে তৈরি হয়েছে কোনও গভীর ক্ষত। আর সেখান থেকেই হিমবাহের গা বেয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা।
আন্টার্কটিকার টেলর হিমবাহের উপরেই রয়েছে এমন রক্ত-ঝরনাটি। ১৯১১ সাল নাগাদ সেই ব্লাড ফলসটি প্রথম খেয়াল করেন গ্রিফিথ টেলর নামে এক অস্ট্রেলীয় ভূতাত্বিক। তাঁর নাম অনুসারেই হিমবাহের নাম রাখা হয় টেলর হিমবাহ।
প্রাথমিক ভাবে মনে করা হত, কোনও অ্যালগি বা ছত্রাকের উপস্থিতির জন্যই ওই জলের রং এমন লাল। সকলেই জানেন, চরম আবহাওয়ার জন্য আন্টার্কটিকায় প্রাণের সন্ধান পাওয়া বেশ কষ্টকর। আশ্চর্যের কথা, তা সত্ত্বেও আন্টার্কটিকায় বসবাস প্রায় ১১৫০ প্রজাতির ছত্রাকের। যার মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতি নাকি বেশ বিরলও। প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়াতেও দিব্যি খাপ খাইয়ে নিতে পারে অ্যালগি বা ছত্রাকেরা। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হত, তেমন কোনও অ্যালগির কারণেই আসলে পাল্টে যাচ্ছে জলের রং। তবে সেটাই একমাত্র কারণ কিনা তা সেসময় খতিয়ে দেখা হয়নি।
আরও শুনুন: প্রকৃতির বিস্ময়! ঝরনার বুকে এ আগুনের শিখা নেভে না কখনও
ফলে এতদিন সত্যিই প্রাকৃতিক বিস্ময় হয়েই বরফের পাহাড়ের উপর দিয়ে বয়ে যেত ওই লাল জলের ঝরনা। তবে ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা একদল গবেষক এত সহজে সেই সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা ওই ঝরনার উৎসের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কেন এ ঝরনার রং এমন লাল! তা নিয়ে শুরু হল গবেষণা। আর তার ফলে যা সামনে এল, তা বেশ অবাক করার মতোই।
গবেষণার পরে বিজ্ঞানীদের ওই দলটি জানালেন, ওই তীব্র লাল রঙের কারণ মোটেও কোনও ছত্রাক বা অ্যালগি নয়। বরং বেশি রকমের ঘনত্বযুক্ত লবণজল ও অক্সিডাইজড আয়রনের ফলেই রক্তের মতো লাল রং ধারণ করে ওই ঝরনার জল। আর বেশি মাত্রায় লবনের উপস্থিতির জন্যই ওই ঝরনার জল চরম ঠান্ডাতেও বরফে পরিণত হয় না। এমনকি তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নীচে নেমে গেলেও তরল অবস্থাতেই থেকে যায় ওই জল। আর সর্বদা হিমবাহের গা বেয়ে নেমে আসতে থাকে ওই রক্তের ঝরনা। ওই লবন জল যে একদিনেই জলকে অমন রক্তবর্ণ করে তুলেছে, তা কিন্তু নয়। প্রায় ১৫ লক্ষ বছর ধরে লবনজলের সঙ্গে আয়রনের বিক্রিয়ার ফসল আন্টার্কটিকার ওই রক্তাক্ত ঝরনা।
আরও শুনুন: গাছের গায়ে যেন ফুটেছে রংধনু! খেয়ালি প্রকৃতির বৈচিত্র বিস্ময় জাগাচ্ছে নেটদুনিয়ার
তবে কারণ যাই হোক না কেন, অমন বরফ ঢাকা হিমবাহের মাঝখানে টকটকে লাল জলের ধারা সত্যিই আশ্চর্য। ধবধবে বরফের চাদরে ঢাকা হিমবাহের বুক চিরে কী ভাবে নেমে আসে রক্তের ধারার মতো জল, তা অবাক করেছে বৈজ্ঞানিকদের। সত্যিই, প্রকৃতির যে কত আশ্চর্য রকমের লীলা, তা ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি।