বিভিন্ন অনলাইন বিপণন সংস্থায় যে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’ চলছে, তা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেছেন। অবিশ্বাস্য কম দামে নাকি পাওয়া যাবে আপনার চাহিদার জিনিসটি, এমনই দাবি নিয়ে হাজির বিভিন্ন ব্র্যান্ড। কিন্তু কী এই ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’? আদৌ কি তার সঙ্গে উৎসবের বা আনন্দের কোনোরকম যোগ আছে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
অগ্রহায়ণ মাসে যেমন বাংলায় নতুন শস্য উঠলে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেমনি এই সময়টায় আসে থ্যাংকসগিভিং। আর নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার পালিত হয় ব্ল্যাক ফ্রাইডে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে কী জানার জন্য আপনি যদি আন্তর্জালের শরণাপন্ন হন, সেখান থেকে জানা যাবে এক মজার ঘটনার কথা। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৫৯ সালে, ফিলাডেলফিয়াতে। সস্তায় জিনিস কেনার জন্য নাকি সেখানে এমন ভিড় হয়েছিল যে পুলিশকে নাওয়া খাওয়া ফেলে ভিড় সামলাতে হয়েছিল। আর তারাই এই দিনটার নামকরণ করেছিল ব্ল্যাক ফ্রাইডে। যদিও ইতিহাস ঘাঁটলে এই দিনটির অন্যরকম এক তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। যা এতটাও সরল নয়, আর এত আনন্দের তো নয়ই।
আরও শুনুন: প্লেন নয়, জাহাজ নয়, বাসে করেই পাড়ি কলকাতা থেকে লন্ডনে… সত্যিই কি ঘটেছিল এমন ঘটনা?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির একটি বড় ভিত্তি ছিল দাসপ্রথা। এই দাসদের অবস্থা পশুর চেয়েও খারাপ ছিল। আফ্রিকা থেকে কালো মানুষদের গায়ের জোরে বন্দি করে নিয়ে আসা হত আমেরিকায়। দাসের জোগানে যেহেতু কমতি ছিল না, সুতরাং তাদের বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা নিয়েও মাথা ঘামাতেন না সাহেব প্রভুরা। অখাদ্য খাবার আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থেকে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হত তাদের। পারিশ্রমিকের বালাই ছিল না, উলটে পান থেকে চুন খসলেই পড়ত চাবুক। এই দাসদের বেচাকেনার জন্য বরাদ্দ দিন ছিল এই ব্ল্যাক ফ্রাইডে। আসলে অক্টোবর মাসের শেষ দিনে হ্যালোইন, নভেম্বর মাসে থ্যাংকসগিভিং, ডিসেম্বরে বড়দিন পেরিয়েই নতুন বছরের প্রস্তুতি… এতরকম উৎসবের তোড়জোড় করার জন্য ধনীদের কাজের লোক প্রয়োজন হত। পাশাপাশি খামারবাড়িতেও তখন ফসল তোলার মরশুম। তার জন্যও শ্রমিক চাই। তাই নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার আমেরিকার প্রায় সর্বত্রই বসত একটা বিশেষ হাট। দাস বেচাকেনার হাট।
আরও শুনুন: বয়স প্রায় ৪০০০ বছর, এখনও অবিকৃত আছে মিশরের প্রাচীনতম মমি
১৮৬৩ সালের ১লা জানুয়ারি এই ঘৃণ্য দাসপ্রথার অবসান ঘটান রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন। অথচ তারপরেও অবসান ঘটল না ব্ল্যাক ফ্রাইডের। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কালো মানুষদের মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব হলেন সারা বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা। এদিকে ভিয়েতনাম তখন কেঁপে উঠছে মার্কিন সেনাদের বুটের আওয়াজে। আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের মনোভাব যখন পৃথিবীর সামনে এসে পড়েছে, তখনই আবার জাগিয়ে তোলা হল ব্ল্যাক ফ্রাইডে-কে। থ্যাংকসগিভিং-এর ঠিক পরেই শুরু হল কেনাকাটায় বিশাল ছাড় দেওয়া। নেহাতই বাণিজ্যিক ভাবনার মোড়কে উসকে দেওয়া হল কালো মানুষদের প্রতি ঘৃণার সেই স্মৃতি। আর আজও অজান্তেই সেই ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে এই বিশেষ নামকরণটি। যেমন বয়ে চলেছে মানুষে মানুষে ঘৃণা, ভেদাভেদ, ভাগাভাগির ইতিহাসও।