শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে তীব্র বিষ। কিন্তু সেই বিষে বাহকের ক্ষতি হয় না কোনও। রূপের আগুন জ্বালিয়ে সে অমোঘ নেশার হাতছানি দেয় সকলের দিকে। আর কেউ তাকে স্পর্শ করলেই ঘনিয়ে আসে অনিবার্য মৃত্যু। বিষকন্যার এমন গল্প শোনা গিয়েছে যুগে যুগে। কিন্তু সত্যিই কি বিষকন্যা বলে কেউ ছিল কখনও? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
যুদ্ধে হেরে গিয়েছেন এক রাজা। তাঁর রাজ্যপাট সব দখল করেছেন শত্রু রাজা। কোনওমতে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন রাজা। আর আত্মগোপন করে তিনি ভেবে চলেছেন, কীভাবে শত্রুকে নিকেশ করা যায়। সেই সময়েই তাঁর মন্ত্রী এসে জানালেন, চিন্তার কারণ নেই। শত্রু রাজাকে বিনাশ করার জন্য একটি অমোঘ অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন তিনি। কী সেই অস্ত্র? মন্ত্রী জানালেন, সে একটি বিষকন্যা। মন্ত্রীর পরিকল্পনা মতোই, সেই কন্যাটিকে কৌশলে শত্রু রাজার সামনে হাজির করানো হল। কিন্তু, পরিকল্পনা পুরোটা ফলল না। রাজার আগেই সেই সুন্দরী মেয়েকে দেখে মোহিত হয়ে গেলেন রাজার বন্ধু। মেয়েটিকে বিয়ের আয়োজনও করলেন তিনি। জ্বলে উঠল যজ্ঞের আগুন। তার সামনে বরের হাতের উপর হাত পড়ল কনের। আগুনের তাপে সে হাত ঘেমে উঠেছে। বর জানলেনও না, হবু পত্নীর ঘামের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর শরীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে তীব্র বিষ। অল্প সময়ের মধ্যে বিষ তার কাজ করল। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন রাজার সেই বন্ধু।
কথা হচ্ছে, এ ঘটনা কি নিছক গল্প? সপ্তম শতকে লেখা রাজনৈতিক নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ এই কাহিনি তুলে এনেছিলেন বিশাখদত্ত। যেখানে উঠে এসেছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যা করার জন্য মহারাজা নন্দের এই ষড়যন্ত্র। বিষকন্যা দিয়েই চন্দ্রগুপ্তকে হত্যা করার চক্রান্ত হয়েছিল বটে, তবে সেই বিষকন্যার সংস্পর্শে এসে মৃত্যু হয় চন্দ্রগুপ্তের বন্ধু পর্বতকের। কিন্তু এমন কোনও নারী কি সত্যিই ছিল? কোনও নারীর শরীর ভরা বিষ, এমনটা কি হতে পারে?
আরও শুনুন: নাচের ছন্দে খসে পড়ত পোশাক, গুপ্তচর মাতা হারির শরীরী আগুনে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিত শত্রুরা
এ কথা অবশ্য অজানা নয় যে, শত্রুকে ঘায়েল করতে বিষের ব্যবহার চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। মনে করা যাক মহাভারতের কথা। পাণ্ডবদের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে ওঠা যাচ্ছে না। বয়স কম হলে কী হয়, বিদ্যায় বুদ্ধিতে শক্তিতে তাদের নাগাল পাওয়া ভার। তাই দুর্যোধনরা ফন্দি আঁটল, সবচেয়ে শক্তিশালী ভাই ভীমকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা যাক। তারপর কী হয়েছিল, সে কথা জানায় মহাভারতের কাহিনি। কিন্তু শত্রুকে বিষ মেশানো খাবার খাওয়ানো বা অন্য কোনও ভাবে তার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া, সে তো সহজ কথা নয়। বিপক্ষের কাছে পৌঁছতে পারলে তবে না এমন কিছু করা সম্ভব! তাই আরও সহজ কিন্তু অব্যর্থ এক উপায় ভেবেছিলেন সেকালের রাজনীতিকেরা। আর সেখান থেকেই উদ্ভব বিষকন্যার। রাজ্যে যেসব সুন্দরী কন্যাসন্তান সদ্য জন্মেছে, অনেকসময় তাদের গোপনে পালন করা হত রাজবাড়িতে। প্রতিদিন তাদের খাবারে অল্প অল্প করে মেশানো হত বিষ। বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু হত অনেকের, কিন্তু কেউ কেউ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যেত। তখন তাদের রূপচর্চার পাশাপাশি শেখানো হত নৃত্য গীত লাস্য আর নানারকম কলা। যাতে সেই নারীদের দেখলে লালসার হাত বাড়াবে যে কোনও পুরুষ। আসলে সেকালে শত্রু মানেই কোনও না কোনও ক্ষমতাশালী পুরুষ। এক রাজার সঙ্গে বিবাদ আরেক রাজার, এক বণিকের প্রতিপত্তি দেখে আরেক বণিকের ঈর্ষা। সেখানে যদি কোনও সুন্দরী মেয়েকে শত্রুর কাছে পাঠানো যায়, তাকে দেখে মোহিত হবেন সেই পুরুষটি। কিন্তু তিনি তো আর জানেন না, সেই রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে তীব্র বিষ। নারীটির সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলেই ঘটবে সর্বনাশ। খোদ চাণক্য রাজাদের সতর্ক করে বলছেন, অচেনা কোনও রমণীকে সম্ভোগ করার আগে ধুয়ে নিতে হবে তাদের ঊরু। কেন-না, তারা বিষকন্যা হতে পারে। চাণক্য এমন কিছু অবিশ্বাসিনী রানির কথাও উল্লেখ করছেন, যাঁরা অলংকারে, কিংবা গাল, স্তন ও নখে মেখে নিয়েছিলেন তীব্র বিষ। আর সেই অবস্থায় রাজাদের মিলনে প্রলুব্ধ করে হত্যা করেছিলেন তাঁদের। অনেকসময় অবশ্য সঙ্গম পর্যন্ত যাওয়ারও দরকার পড়ত না। বলা হয়, বিষকন্যাদের মধ্যে অনেকের নাকি নিশ্বাসেই মিশে থাকত বিষ। সে কথা বললে, তাকে কোনও না কোনও ভাবে স্পর্শ করলেই ঘনিয়ে আসত মৃত্যু।
আরও শুনুন: নগ্নতাই যখন পেশা, কেমন কাটে ন্যুড মডেলদের দিন?
কিন্তু আসলে কি এই নারীদের শরীরে বিষ থাকত? নাকি তা রূপক মাত্র? আসলে কি দেহের গোপন স্থানে লুকোনো থাকত বিষ বা অন্য কোনও অস্ত্র? আর সেই বিষ দিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে শত্রুনিধন করত বলেই কি বিষকন্যা আখ্যা পেয়েছিল তারা? তেমন ইঙ্গিতও কিন্তু রয়ে গিয়েছে একাধিক কাহিনিতে। বলা হয়, সদ্যোজাত কন্যার জন্মলক্ষণ বিচার করে জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, সেই কন্যা ভবিষ্যতে বিষকন্যা হয়ে উঠবে কি না। তাঁরা বিষকন্যা বলতে বোঝাতেন এমন কোনও নারীকে, যে তার কোনও না কোনও প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠবে। বলাই বাহুল্য, পিতা কিংবা পতির নিরাপত্তার দিকেই গুরুত্ব দিত সেকালের সমাজ। আর তাই, এহেন গণনার পরে অনেকসময়ই হত্যা করা হত সেই সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে। আর যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখাও হত, সেক্ষেত্রেও রাজনীতির ঘুঁটি হওয়াই ছিল তার নিয়তি। রাজার নির্দেশে রাজারই কোনও শত্রুকে হত্যা করা, আর তার শাস্তি হিসেবে নিজেরও মৃত্যু, ভাগ্যের এই লিখনেই বাঁধা পড়েছিল বিষকন্যারা। মেয়েদের প্রাণের দাম যে আসলে সমাজের কাছে কানাকড়িও নয়, সে কথাই বোধহয় আরও একবার বুঝিয়ে দেয় বিষকন্যাদের এই কাহিনি।