১৯০৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কনফারেন্সে ব্রিটেনের পতাকাকেই ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে উত্তোলন করার প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন এক মাঝবয়সি মহিলা। ব্যাগ থেকে একটি পতাকা বার করে বললেন, এটি হল ভারতের আসল পতাকা। এভাবেই দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছর আগে তিনি উত্তোলন করেছিলেন ভারতের জাতীয় পতাকা। তাও আবার আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বিভিন্ন দেশের অভ্যাগতদের সামনে। স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে শুনে নেওয়া যাক সেই মহানুভবের অদম্য সাহসের কাহিনি।
দেশের মাটিতে তখন ঝরে পড়ছে হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্ত। হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরছেন বিপ্লবীরা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আন্দোলনের প্রবাহে গা ভাসাচ্ছেন ভারতীয়রা। লক্ষ্য একটাই, ব্রিটিশ রাজ থেকে মুক্তি। দেশের মাটিতে বিদেশি পতাকা নামিয়ে দেশের পতাকা উত্তোলন করা। জার্মানির মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই কাজই করেছিলেন ভিখাজি রুস্তম কামা। মাদাম কামা নামেই সবার কাছে তিনি পরিচিত। ১৯০৭ সালের ২২ আগস্ট তাঁর এমন দুঃসাহসিক কাজ প্রত্যক্ষ করেছিলেন বিশ্ববাসী। শুধুমাত্র তাই নয়, দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মহীয়সী সাহায্য করেছিলেন বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকেও। ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও, বিলাসিতায় গা ভাসাননি। দেশের স্বাধীনতাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
আরও শুনুন: ছদ্মনামে আত্মগোপন, মৌলবাদী ফতোয়ায় অন্তত ৫৬ বার বাড়ি বদল করেছিলেন রুশদি
নিজে হাতেই তিনি বানিয়েছিলেন দেশের পতাকা। বর্তমানে দেশের জাতীয় পতাকার উত্তরসূরি বলা যেতে পারে মাদাম কামার সেই পতাকাটিকে। নিজের ভাবনায় তৈরি সেই পতাকা নিয়েই বিশ্বের দরবারে দেশের মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সকলকে। তাঁর জেদ ও জোরের কাছেই সেদিন মাথা নত করেছিলেন সবাই। বলা যায়, তিনি একাই সেদিন সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের বাধ্য করেছিলেন, ব্রিটেনের পতাকার বদলে ভারতের স্বতন্ত্র জাতীয় পতাকা উত্তোলনে।
মুম্বইয়ের এক সচ্ছ্বল পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও দেশের জন্য ত্যাগ করেছিলেন সমস্ত বিলাসিতা। ১৮৯৬ সালে ভয়ংকর মহামারীর সম্মুখীন হয়েছিল বিশ্ব। প্লেগের প্রকোপ থেকে বাদ যায়নি ভারতও। সেই সময় অগণিত সাধারণ মানুষ ভিখাজিকে যেন নতুন করে চিনেছিলেন। বিলাসিতা ছেড়ে গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন চাপিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন গ্রামে গ্রামে। রোগীদের সেবা করতেন নিজের হাতে। নিজের জীবন উপেক্ষা করেই অন্যকে বাঁচানোর মন্ত্রে দীক্ষিত ভিখাজির তখন একটাই পরিচয়- তিনি সকলের ‘মা’। একসময় নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন। লন্ডনে যান চিকিৎসার জন্য। প্রাণ রক্ষা হয় মাদাম কামার।
আরও শুনুন: বরযাত্রীর ছদ্মবেশে অভিযান আয়কর গোয়েন্দাদের, মহারাষ্ট্র থেকে উদ্ধার বিপুল টাকা ও সোনা
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে তিনি ছিলেন ‘বিপ্লবের জননী’। স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি ভারতীয় নারীদের অধিকার নিয়েও তিনি লড়াই করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল খুবই স্পষ্ট। সব ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতেন তিনি। তাঁর কাছে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে ভারতীয় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই- কোনও আলাদা বিষয় ছিল না। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন পারসি। অসুস্থ হয়ে লন্ডনে চলে আসার পর সেখান থেকেই করতেন বিভিন্ন কাজ। বিদেশের মাটিতে বার বার প্রচার করতেন ভারতীয়দের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি। ভারতে নিত্যদিন চলতে থাকা ব্রিটিশদের অত্যাচার, দুর্ভিক্ষ, অসহায়তার কথা তুলে ধরতেন সবার সামনে। তাঁর স্বামী অবশ্য ব্রিটিশদের পছন্দ করতেন। কিন্তু ব্যক্তিসম্পর্কের কারণে নিজের দেশব্রতে এতটুকু খামতি ছিল না মাদাম কামা-র। ১৯০৯ সালে তৈরি করেছিলেন ‘প্যারিস ইন্ডিয়ান সোসাইটি’। এর উদ্দেশ্য ছিল, ইউরোপে থাকা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্রয় দেওয়া। তাঁদের প্রধান কাজ ছিল ইউরোপ-সহ বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা ছড়িয়ে দেওয়া। দেশে যখন স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদযাপনে সর্বত্র উত্তোলিত হচ্ছে তেরঙ্গা, তখন অবশ্যই স্মরণ করতে হয় মাদাম কামাকে। ব্রিটিশদের পতাকা ভারতের পরিচয়বাহী নয়, দেশের আছে নিজস্ব জাতীয় পতাকা- এ-কথা জোর দিয়ে গোটা বিশ্বে সামনে তিনিই তুলে ধরেছিলেন।