বাংলা ভাষা পৃথিবীর সেই বিরল ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম, যে ভাষার জন্য শহিদ হতেও দ্বিধা করেননি অনেক মানুষ। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ভাষা আন্দোলনের কথা কে না জানে! কিন্তু জানেন কি, কেবল ভারত বা বাংলাদেশ নয়, সুদূর আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশেও সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে এই বাংলা ভাষা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। সদ্যগঠিত পাকিস্তানে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার দাবিতে পথে নেমেছিলেন দলে দলে মানুষ। আর সেই মিছিলের উপরেই নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল সেনারা। শহিদ হয়েছিলেন একাধিক ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের পথ এরপর গড়িয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দিকে। অবশেষে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যার সরকারি ভাষা বাংলা। আর ২০০২ সালে যখন সেই দেশে ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে, সেই বছরেই বাংলাকে তাদের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের একটি আফ্রিকান দেশ, সিয়েরা লিওন।
আরও শুনুন: মুক্তিযুদ্ধের দরুন পাওয়া গেল ORS, বিশ শতকের সেরা আবিষ্কারের কৃতিত্ব তিন বাঙালির
কিন্তু হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই দেশটি?
আসলে এর পিছনেও ছিল এক ভয়ংকর রক্তঝরানো যুদ্ধের ইতিহাস। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল ঘেঁষা এই দেশটিতে রয়েছে হিরে, সোনা, বক্সাইট এবং টাইটানিয়ামের খনি। অথচ তার দারিদ্র্য ঘোচেনি। মূল্যবান খনিজগুলির জন্য দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডের দখলে ছিল সিয়েরা লিওন। ১৯৬১ সালে বিদেশি প্রভুদের অত্যাচার থেকে রেহাই মেলে। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও দেশে শান্তি ফিরল না। ১৯৬৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী মিল্টন মারগাই মারা যেতে না যেতে দেশ জুড়ে অরাজক পরিস্থিতি জাঁকিয়ে বসে। যা বাড়তে বাড়তে ১৯৯১ সালে শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। আফ্রিকার সবচেয়ে রক্তাক্ত ও ভয়াবহ গৃহযুদ্ধগুলোর অন্যতম সিয়েরা লিওনের এই যুদ্ধ। ২০০২ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
আরও শুনুন: পাখির ভাষায় কথা বলেন এই মানুষেরা, কোথায় শোনা যায় এমন ভাষা?
যেহেতু যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না, সেই কারণে জাতিসংঘ বাধ্য হয়ে আসরে নামে। সেটা ১৯৯৯ সাল। বাংলাদেশ সহ আরো অনেক দেশ জাতিসংঘের এই শান্তি মিশনে যোগদান করে। জাতিসংঘের প্রেরিত প্রথম দলে ছিলেন ৭৭৫ জন বাংলাদেশি সেনা। যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি শান্তি কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশের মোট ১২ হাজার সেনা। এমনকি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও দেশটিকে নতুনভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা। সাধারণ দেশবাসীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তাঁদের। স্বাভাবিকভাবেই দুই দেশের মানুষের মধ্যে ভাষার আদানপ্রদান ঘটে। পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিরও প্রসার ঘটে এই অঞ্চলে। আর এই সম্পর্কের স্বীকৃতি হিসেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আফ্রিকার দেশটি। রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত হয়েছিল বাংলা ভাষা।