ভাষার লড়াই থেকে শাহবাগ, যে কোনও আন্দোলনে বরাবরই ছাত্রছাত্রীদের মিছিলের সামনে পেয়েছে বাংলাদেশ। মিছিলে মৃত্যুতে দেখেছে তরুণদের মুখ। তাঁদের পথ ভুল হতে পারে, মতেও থাকতে পারে বিরোধ, তবে সেই তরুণ আবেগকে সঙ্গে করেই পথ হাঁটে দেশ।
লাঠির মুখে গানের সুর নিয়েই দেশে দেশে কালে কালে পথে নামে ছাত্রছাত্রীরা। কখনও পথ ভুল হয়। কখনও সুরও কাটে। কখনও সে সুরের মাঝে অন্য কোনও স্বার্থ তার স্বর মিশিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এসবের মাঝেও জেগে থাকে আঠেরোর আবেগ। আর তারুণ্যের সেই আবেগকেই বারবার চিনেছে আন্দোলনের বাংলাদেশ।
আরও শুনুন:
ভাষাকে ভালবেসেই শহিদ-তর্পণ, একুশে স্মরণ তাঁদের ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন যাঁরা
দেশভাগের পর থেকেই নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার টিকিয়ে রাখতে সমস্যায় পড়ছিলেন ওপার বাংলার মুসলমান বাঙালি। আর সেই সংকট থেকেই জন্ম ভাষা আন্দোলনের। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশি দমনের জেরে নিহত হন সেই আন্দোলনের একাধিক প্রতিবাদী মুখ। পরবর্তী কালে ভাষাশহিদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন— আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। কিন্তু ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী লিখেছিলেন,
‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়…’
২১ ও ২২ তারিখে এঁরা ছাড়াও সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হন বলেই মনে করেন গবেষকেরা, যাঁদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা যায়নি। এই ভাষা দিবসের আন্দোলনই ক্রমে ক্রমে রূপ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের। ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীনতা চাওয়ার সেই লড়াইয়েও পুরোভাগে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছাত্ররা, তাঁদের সঙ্গে ছিলেন শিক্ষক-অধ্যাপকেরাও। বুকে গুলি লেগেছে, নিজের কবর খুঁড়তে হয়েছে নিজেকেই, তবুও নির্মম অত্যাচারের সামনেও পিছু হটেননি তাঁরা। উৎসবের দিনে নয়, সংকটের মুখেই যে দেশকে আগলে রাখতে হয়, তারকা থেকে আমজনতা সকলকে সে পাঠ দিয়েছিলেন শিক্ষাব্রতীরাই।
৫২ থেকে ৭১-এর এই দীর্ঘ সংগ্রামের পরেও আবার জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। সে আন্দোলনের আত্মাকে যে দেশ হারিয়ে ফেলেনি, তা বোঝা গিয়েছিল ২০১৩-র শাহবাগ আন্দোলনেই। একাত্তরের এক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। অনেকেই বলেছিলেন, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র লন্ডভন্ড করে দেওয়া ‘আরব বসন্ত’-এর হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশের পালে। শাহবাগ হয়ে উঠেছে ‘তাহরির স্কোয়ার’। এমনিতে ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে যে বিবাদ বিসংবাদ হাতাহাতি লেগে থাকে, ২০১৩-এর শাহবাগে তার সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে হেঁটেছিলেন আন্দোলনকারীরা।
এরপরে ২০১৮তেও পরিবহণের মতো দৈনন্দিন বিষয়কে ঘিরে ফের প্রতিবাদে মুখর হয় বাংলাদেশের ছাত্র-যুবরা। নিতান্ত কিশোরবয়সি বিদ্যালয়-পড়ুয়ারাই কেবল পথ অবরোধ করেনি, তারা হাতেকলমে দেখিয়ে দেয় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হওয়া উচিত। রেষারেষির দৌড়ে ব্যস্ত বাসের তলায় দুই পড়ুয়ার মৃত্যুতেই এই আন্দোলনের শুরুয়াত, কিন্তু অসংখ্য ছেলেমেয়ের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে আসা আসলে জনমানসের অনেকদিনের জমে থাকা ক্ষোভকেই চিনিয়ে দিয়েছিল।
আরও শুনুন:
কথা বলার অধিকার থাকুক, তবে কথা শোনার অভ্যাসও জরুরি
এখনকার সময়টা ক্রমশ নিজের স্বার্থ নিজে বুঝে নেওয়ার সময় হয়ে উঠেছে। বাইরের দুনিয়া যত প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে, ততই টিকে থাকার তাগিদে মানুষ আরও নিজের গণ্ডিকে আঁটসাঁট করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেই বোধ চারিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রথম থেকেই। তাই দেখা যায়, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির আদানপ্রদান জারি থাকবে কি না তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অথচ নিছক ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে গিয়ে যে ছাত্রছাত্রীরা দেশের কথা ভাবেন, তাঁদের সেই পরিসরকে তো মান্যতা দিতেই হয়। তরুণ প্রজন্ম যে দেশকে আগলে রাখতে তৈরি, তার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, সে কথা ৫২-য় সত্যি ছিল, সত্যি ছিল ৭১-এ, ২০১৩-তে সে কথা সত্যি ছিল, আবার ২০২৪-এও পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছেন বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা। বাহান্ন থেকে চব্বিশ, বাংলাদেশে বারেবারে প্রতিবাদ জেগে উঠেছে ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠেই। সে কণ্ঠ রোধের চেষ্টাও কম হয়নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা পথে নামলেন, শহিদ হলেন, ভাই-বন্ধুদের শহিদ হতে দেখলেন, তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে নানারকম কথা উঠছে এখন। এ কথাও মনে না রেখে উপায় নেই যে, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে রাজনীতির সর্পিল ফাঁদ বারেবারেই গ্রাস করতে চেয়েছে। ভোট রাজনীতির হিসেব মাথায় রেখে ছাত্র-যুবদের শাসক বিরোধী সকলেই আত্মসাৎ করতে চায়। তাই নাগরিক প্রতিবাদ প্রথমে সৎ ও নিরপেক্ষ হলেও তা ধীরে ধীরে রাজনীতির বিষকুম্ভে তলিয়ে যেতে থাকে, এ কথা সত্যি। কিন্তু এ কথাও সত্যি, রাষ্ট্রব্যবস্থার এই আস্ফালনের মুখেই নতুন আলো দেখাতে পারে ছাত্র রাজনীতি, বলা ভালো প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিই। শেষ এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যত আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, সবেই নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্র রাজনীতি। বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলনের ঠিক ভুল নিয়ে কথা উঠছে, কথা হওয়া কাম্যও। কিন্তু আন্দোলনকারীদের প্রথম থেকেই ‘অপর’ করে রাখা যে রাষ্ট্রের মানবিক মুখকে উজ্জ্বল করে না, সে কথাটিও মনে রাখা ভালো।