ইঁদুর পেয়েছে স্বর্ণপদক! শুনতে অবাক লাগলেও, সত্যি। কিন্তু কেন একটি ইঁদুরকে দেওয়া হল এমন শিরোপা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই বাহাদুর ইঁদুরের কীর্তি। শোনাচ্ছেন, সৌভিক সরকার।
তিনি বৃদ্ধ হলেন। কাজ থেকে নিলেন অবসরও। কিন্তু তার আগে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন স্বর্ণপদক। ইঁদুর হয়েও দেশ ও দশের স্বার্থে এমন কাজ তিনি করলেন, যার দ্বিতীয় কোনও নজির নেই। সম্মাননীয় এই ইঁদুরের নাম মাগায়া। বয়স সাত। আপাতত অবসর জীবন কাটাচ্ছেন এই ইঁদুর বাহাদুর।
তা, এই ইঁদুরের বাহাদুরিটা ঠিক কী? কেনই বা তাঁকে সরকার দিল স্বর্ণপদক? বলতে গেলে, স্বীকৃতি দেওয়ার মতোই আশ্চর্য কাজ করেছেন মাগায়া। পাঁচ বছরের কেরিয়ারে একাত্তরটি ভয়াবহ ল্যান্ডমাইন আর আর প্রচুর বিস্ফোরক খুঁজে বের করেছিলেন তিনি।
যদিও মাগায়ার জীবন শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা স্বজাতীয় ভাই বেরাদরদের মতোই। দানা খুঁটে, এটা সেটা কেটে-কুটে দিব্যি দিন কাটছিল। ভাগ্য বদলে দিল বেলজিয়ামের একটি সংস্থা, নাম আপোপো। তারা আফ্রিকার তানজানিয়ায় একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালায়। গত দু-দশক ধরে তাঁরা হরেক প্রাণীকে, হরেক কিসিমের জিনিস শিখিয়ে চলেছে। ইঁদুরদের তারা শেখায় ল্যান্ডমাইন খুঁজে বের করার কৌশল। মাগায়া ভরতি হয়েছিল সেই ক্লাসে, এক বছরের শিক্ষার শেষে মিলেছিল সার্টিফিকেট।
আরও শুনুন : World Map: বদলে যেতে পারে পৃথিবীর মানচিত্র, কেন জানেন?
কিন্তু কেনই বা ইঁদুরদের এই কাজে লাগানো এমন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? কম্বোডিয়া দেশটার দিকে তাকালেই তার উত্তর মেলে। কয়েক দশক ধরেই গৃহযুদ্ধের গনগনে আঁচের ওপর শুয়ে দেশটি। আটের দশক থেকে এখনও পর্যন্ত অন্তত পঁয়ষট্টি হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছে এর জেরে। গুরুতর জখম হয়েছেন অন্তত পঁচিশ হাজার মানুষ। এখনও কম্বোডিয়ার এক হাজার স্কোয়ার কিলোমিটার অঞ্চলে থরথরে মাটির নীচে শোয়ানো আছে মাইন। যে কোনও মুহূর্তে, বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে সবকিছুই।
এরকম মাইন উদ্ধারে স্নিফার ডগ থেকে বিদেশি নানা যন্ত্র কাজে লাগে। তারপরও এরকম ইঁদুরের ওপর ভরসা করা কেন? ইঁদুরদের প্রশিক্ষক বলেন, ‘ইঁদুরদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। খরচ যৎসামান্য। খুব সহজে একদম নির্ভুল জায়গায় তারা পৌঁছে যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা, ইঁদুরগুলি এতই বাধ্য, কামড়ায় না। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় মাগায়ার কথা। ওর পারফরম্যান্স দুর্দান্ত। ওর চেষ্টায় আমরা বহু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি।’ আসলে, এই ইঁদুরদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে বিস্ফোরকের কেমিক্যাল কম্পাউন্ডগুলো তারা অতি দ্রুত এবং সহজে চিনে ফেলতে পারে। ফলে সহজেই তারা খুঁজে পায় ল্যান্ডমাইন। খুঁজে পেলেই সঙ্গের হ্যান্ডলার বা অন্য সহকর্মীদের জানান দেয়।
বীর বাহাদুর ইঁদুর মাগায়া এখনও পর্যন্ত চষে ফেলেছে দেড় মিলিয়ন স্কোয়ার কিলোমিটার। আরও সহজ করে বললে প্রমাণ মাপের কুড়িটি ফুটবল মাঠের সমান জায়গা। একটা প্রমাণ সাইজের টেনিস কোর্ট তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলতে মাগায়ার লাগে মাত্র কুড়ি মিনিট। সেখানে একজন দক্ষ বম্ব ডিসপোজাল কর্মীর মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পুরো এলাকা কভার করতে লেগে যাবে অন্তত একটা পুরো দিন।
আরও শুনুন : ৩৫ বছর পর কঙ্কাল নিয়ে ফিরেছিল হারানো বিমান, কী সেই রহস্য?
অতএব বোঝাই যাচ্ছে, মাগায়া ইঁদুর হলেও, ঠিক কেমন করিতকর্মা ছিলেন। ২০২০-র সেপ্টেম্বরে তাই মাগায়াকে ব্রিটেনের জর্জ গোল্ডেন ক্রস বা সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান পিডিএসএ গোল্ডেন মেডেল দেওয়া হয়েছিল। মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে এই সম্মান দেওয়া হয়। এই পুরস্কারের ৭৭ বছরের ইতিহাসে, মাগায়াই প্রথম কোনও ইঁদুর, যে এই সম্মানে সম্মানিত হল।
মাগায়া অবসর নেওয়ার পর, আরও একদল ইঁদুরকে কম্বোডিয়ার সরকার এনেছেন একই কাজের জন্য। অবসর জীবনে মাগায়া আপাতত কিছুদিন তাদের মেন্টর হিসেবেই কাজ শেখাবেন। বাহাদুর ইঁদুরের বাহাদুরির লিগ্যাসিটুকু যাতে থেকে যায়, সেটুকুও নিশ্চিত করে দিয়ে যাচ্ছেন মাগায়া।