কোভিড-নাইন্টিন আসবার আগে, সত্যিই যে দুনিয়ার মানুষ এতখানি ঘরকুনো আর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, তা ভাবতেই পারেনি কেউ। কোভিড-পরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে, সমাজের এক বড় অংশের মানুষ বাড়ির চৌহদ্দিতে বসেই অফিসের সমস্ত কাজ করতে পারছে। ঘরে বসেই একদিকে যেমন ব্যবসা করছে মানুষ, অন্যদিকে বন্ধুত্ব পাতানো থেকে ফলোয়ার বাড়ানো- সবটাই চলছে বাড়ির পরিসরের মধ্যেই। কিন্তু দিনশেষে দুঃখ-বিষাদ ঠেকিয়ে রাখবার ক্ষমতা কোন মানুষেরই বা রয়েছে? আর তাই অন্যান্য বিষয়ে যত সাবলীলই হোক না মানুষ, একাকীত্বের হাত থেকে পালাতে পারছে না কোনওভাবেই।
আজ থেকে পাঁচ বছর বাদে হয়তো আপনার আর কোনও মানুষ বন্ধু থাকবে না। বরং সে সময়ে আপনার সর্বক্ষণের সুখ-দুঃখের সাথি হবে এআই চ্যাটবট (Artificial Intelligence)! আর এমন কথা এখন হয়তো আজগুবি মনে হতে পারে, তবে বলছেন স্বয়ং মেটা-কর্তা মার্ক জুকারবার্গ। যিনি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মানুষকে এক জায়গায় এনে গড়েছেন বন্ধুনগর, তাঁর এমন কথা গুরুত্বপূর্ণ বইকি! তবে এমন দাবি করে কাউকে ভয় দেখানো তাঁর উদ্দেশ্য নয়। যে সমস্ত মানুষ বাস্তবজীবনে ভীষণরকম একা, তাদের বরং আশ্বাস দিয়েই জুকারবার্গ এ কথা জানিয়েছেন।
কিন্তু সত্যিই কি এমনটা হওয়া সম্ভব? হঠাৎ কেনই বা এমন পরিকল্পনা নিলেন ফেসবুক-স্রষ্টা?
আমাদের অজান্তেই আমরা এক অদ্ভুত ধরনের মহামারীর শিকার হচ্ছি। কিছুদিন আগেই এ প্রসঙ্গে তাঁর শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন বিল গেটস। এ মহামারীর নাম তিনি দিয়েছেন ‘লোনলিনেস এপিডেমিক’ অর্থাৎ একাকিত্বের মহামারী। সক্কলের থেকে একা হতে হতে নিজেকে বাড়ির এককোণে আবদ্ধ করে ফেলছে মানুষ। অন্যের সঙ্গে মেলামেশার ইচ্ছে বা বাসনা দুইই সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলছে। আর এভাবেই মৃত্যু গ্রাস করছে তাকে। অথচ সে ভাবছে, একা একাই দিব্যি চলছে জীবন! মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ‘একাকিত্ব’ ছাড়া অন্য কিছু অনুভবেই আসছে না তার! জুকারবার্গের ভাবনার মূল লক্ষ্যই এই মহামারী প্রতিরোধ। তিনি বলছেন, আগামীদিনের ‘এআই-পাওয়ারড্ কম্প্যানিয়ন’-রা (Artificial Intelligence) আচরণ করবে একেবারে মানুষের মতোই। তারা দিনশেষে বন্ধুর দুঃখের গল্প শুনবে, প্রয়োজনে নিজের মতামতও দেবে। বিষাদের দিনে তারাই হয়ে দাঁড়াবে ‘থেরাপিস্ট’। আবার মানুষ চাইলে প্রেমিক অথবা প্রেমিকা হয়ে একাকীত্ব ঘোচাবে এই চ্যাট-বটরাই(Artificial Intelligence)!
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এমন দাবিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ কোভিড-নাইন্টিন আসবার আগে, সত্যিই যে দুনিয়ার মানুষ এতখানি ঘরকুনো আর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, তা ভাবতেই পারেনি কেউ। কোভিড-পরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে, সমাজের এক বড় অংশের মানুষ বাড়ির চৌহদ্দিতে বসেই অফিসের সমস্ত কাজ করতে পারছে। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম কালচার’-এর রমরমার সূচনাই তো হল এ সময়ে। এছাড়াও বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত। ঘরে বসেই একদিকে যেমন ব্যবসা করছে মানুষ, অন্যদিকে বন্ধুত্ব পাতানো থেকে ফলোয়ার বাড়ানো- সবটাই চলছে বাড়ির পরিসরের মধ্যেই। কিন্তু দিনশেষে দুঃখ-বিষাদ ঠেকিয়ে রাখবার ক্ষমতা কোন মানুষেরই বা রয়েছে? আর তাই অন্যান্য বিষয়ে যত সাবলীলই হোক না মানুষ, একাকিত্বের হাত থেকে পালাতে পারছে না কোনওভাবেই। এ সমস্ত মাথায় রেখেই তাই জুকারবার্গের এহেন প্রস্তাব।
কিন্তু যন্ত্রমানব (Artificial Intelligence) কি সত্যিই মানুষের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারবে কখনও? হলিউডি সিনেমা কিংবা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো যন্ত্র যদি মানুষের শত্রু নাও হয়ে উঠতে পারে, মানুষ-বন্ধুর জায়গা নিতে পারবে কি? একাকিত্ব পাকাপাকি ঘোচানোর এই অভিনব উপায় কি পরোক্ষে আরও কোণঠাসা করে দেবে না মানুষকে? সে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়। আর উত্তর তোলা সময়ের হাতেই। বন্ধুর দুনিয়া পালটে গেলে মানুষের বেঁচে থাকা বন্ধুর হয়ে উঠবে কি-না, তা নির্ধারণ করবে মানুষই।