‘বেটিয়া পরায়া ধন’, তাছাড়া বংশরক্ষার অধিকারও কেবল ছেলেদের। তাই আজও বহু জায়গাতেই মেয়েদের কদর নেই পরিবারে। আজও ভারতবর্ষের বহু কোণাতেই কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। আজও তাই সেসব ঘটনাকে নিয়ে তৈরি করতে হয় ‘জয়েশভাই জোরদার’-এর মতো সিনেমা। নানা ধরনের পদক্ষেপ, আইনি কড়াকড়ির পরেও কি আদৌ বদলেছে অবস্থাটা। না, সর্বত্র নয়। এখনও কান পাতলেই নারী ধর্ষণ, খুন কিংবা বধূনির্যাতনের খবর। এত সব নিরাশার মধ্যেও একটুকরো অক্সিজেন রাজস্থানের এই গ্রাম। কী হয় সেখানে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বনফুলের লেখা সেই ‘নিমগাছ’ গল্পটার কথা মনে পড়ে? যেখানে গল্পের এক্কেবারে শেষে গিয়ে বাড়ির গৃহককর্মে নিপুণা বউটির সঙ্গে নিমগাছটির তুলনা টেনেছিলেন লেখক। এ সমাজে গাছ আর মেয়েরা সত্যিই যেন সমার্থক। মানুষ নিজের প্রয়োজনে গাছ কাটে, ছেঁড়ে উপড়ে নেয়। ভুলে যায় গাছ না থাকলে একদিন পৃথিবীতে সব অক্সিজেন যাবে ফুরিয়ে। এই পৃথিবীটা চলতে চলতে আর চলবে না। এ সমাজে মেয়েরাও যেন তেমনই। বংশরক্ষা, ‘পরায়া ধন’ এমনই নানা চাহিদা আর তকমার ফাঁদে আজও বহু জায়গাতেই নির্বিচারে চলে কন্যাভ্রূণ হত্যা বা নারী নির্যাতনের মতো ব্যাপার। ‘মাত্রুভূমি’ সিনেমায় আমরা দেখেছি তেমন সমাজের গল্প, যেখানে মেয়েদের অভাবে শুধু একটা পরিবার নয়, গোটা গ্রাম মেতে উঠতে পারে কী পৈশাচিক বর্বরতায়। এত সচেতনতা, আইনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও বদলায় না অবস্থাটা। আইন করেই রোখা যায় না বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা।
তবে শুধুই খারাপ আর আশাহীনতা? কোথাও কী ভাল কিছু নেই? আলবাত আছে। রাজস্থানের পিপলান্ত্রি গ্রামের কথাই ধরুন না। কিছু না থাকলেও অন্তত সেখানে চেষ্টাটুকু আছে। একাধারে কন্যসন্তান ও সবুজ, দুটোকে বাঁচাতেই সচেষ্ট হয়েছে এই গ্রাম।
আরও শুনুন: পুরুষদের কাজ আবার কী! বাড়ির বাধা উড়িয়ে গাড়ির মেকানিক হয়েই স্বপ্নপূরণ তরুণীর
এ গ্রামে কন্যাসন্তানের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ে থাকে সবুজ। মাটি থেকে মাথা চাড়িয়ে দেয় সবুজ ডালপালারা। কারণ রাজস্থানের পিপলান্ত্রি গ্রামে তেমনটাই রীতিই। এ গ্রামে একটি কন্যাসন্তান জন্মালে ১১১টি চারা পোঁতেন এ গ্রামের মানুষ। সদ্যজাত কন্যার সঙ্গে সঙ্গেই বড় হয়ে ওঠে গাছগুলি। আলো দেয়, বাতাস দেয়, দেয় ফুলফল। সে সব কাজে লাগে মেয়েটির পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে। গত ১৫ বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে পিপলান্ত্রি গ্রামে।
সন্তানের মতো করেই গাছগুলিরও রক্ষণাবেক্ষণ করেন গ্রামবাসীরা। শুধু তাই নয়, কন্যা জন্মানোর পরে গ্রামীণ পঞ্চায়েতের তরফ থেকে ৩১ হাজার টাকা ও সদ্যোজাতের বাবা-মায়ের থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে খোলা হয় একটি ফিক্সড ডিপোজিট। তার পর একটি বিশেষ সময় পরে সুদসমেদ সেই টাকা তুলে দেওয়া হয় পরিবারের হাতে। কন্যাসন্তান জন্মানোর পরেই পঞ্চায়েতের তরফেই দায়িত্ব নিয়ে গোটা কাজটি করে দেওয়া হয়।
আরও শুনুন: ২০২২-এও বদলায়নি অবস্থা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই হাত বাঁধা মেয়েদের, বলছে মানবাধিকার কমিশন
আর এই কাজের একটা বড় অংশের কৃতিত্ব যার, তিনি ওই গ্রামের প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান শ্যাম সুন্দর পালিওয়াল। বেশ কয়েক বছর জলশূন্যতায় ভুগে মারা যায় তাঁর বছর আঠেরোর মেয়ে কিরণ। তাঁরই স্মৃতিতে গ্রামে এই বিশেষ উদ্যোগ শুরু করেন শ্যাম। প্রতি বছর এখন ষাট জনের বেশি কন্যাসন্তান জন্মাচ্ছে পিপলান্ত্রি গ্রামে। গত ছ-বছরে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে গ্রামের সবুজ। অন্তত আড়াই লক্ষ গাছ বসানো হয়েছে এই ছ-বছরে। নিম থেকে শুরু করে আম, জাম, আমলকি কী গাছ নেই সেই তালিকায়। গ্রামে যেন সবুজের অভাব না হয় কখনও। জলের অভাবে কোনও দিনও যেন কারওর কোল না শূন্য হয়, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন প্রাক্তন ওই পঞ্চায়েত প্রধান। তার সঙ্গে কন্যাসন্তান যে শুধুই দায়িত্ব বা বোঝা নয়, অবিবাম সৌভাগ্য ও সুখের চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে বাড়ির মেয়েটিও, তা-ও বোঝাতে চান শ্যাম। সমাজের পাশাপাশি পরিবেশকে সুস্থ রাখতে তাই সবুজ বাড়ানোর বার্তাও ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। আর এই দুই লক্ষেই লড়ে যাচ্ছে রাজস্থানের ছোট্ট গ্রাম পিপলান্ত্রি।