প্রতিদিনের এই কর্মব্যস্ত জীবনে ছুটে চলতে চলতে কতবারই তো মন বিদ্রোহ করে ওঠে। কতবারই তো গুপিবাঘার মতো বলে উঠতে ইচ্ছা হয়, “দুনিয়ায় কত আছে দেখবার, কত কী জানার কত কী শেখার, ঘরে কেন বসে রয়েছি বেকার!” তবে বললেই কি আর বেরিয়ে পড়া যায় সব কিছু ছেড়েছুড়ে। হাজার রকম কাজের ফিকির হাত-পা চেপে ধরে। তবে কেউ কেউ এমনও আছেন, যাঁরা পারেন সে সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করতে। বিশ্বভ্রমণের নেশায় ঘরদুয়ার, সংসার ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকতে পারেন একটানা ২২ বছর। তবে একা নয়, সপরিবারে। আসুন, শোনা যাক এমনই এক ব্যতিক্রমী পরিবারের বিশ্বভ্রমণের গল্প।
তাঁদের পায়ের তলায় যেন সর্ষে। তাই এক জায়গায় একটানা মন টেকানো তাঁদের পক্ষে বেশ কঠিন। গুনে গুনে ২২ বছর বাড়ির বাইরে ছিলেন তাঁরা। শুধু বাড়িই নয়, নিজের দেশ থেকেও ছিলেন তাঁরা অনেক অনেক দূরে। দেশ দেখবার নেশায় সেই কবে বেড়িয়ে পড়েছিলেন নিজের ঘর-দুয়ার, শহর ছেড়ে। তার পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রায় ৫টি মহাদেশ। চষে ফেলেছেন প্রায় শতাধিক দেশ।
না, একা নয়, বরং এ সমস্তটাই করেছেন তিনি সপরিবারে। আর এখানেই তাঁরা ব্যতিক্রমী। এই গোটা সময়টাই কার্যত কেটেছে তাঁদের রাস্তায় রাস্তায়। অবশেষে ২২ বছরের ভুবন পরিক্রমা শেষ করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন এই আর্জেন্তিনার এই পরিবার। তাঁদের বরণ করে নিতে ছুটে এসেছিলেন প্রতিবেশীরা। রাস্তায় তখন যেন উৎসবের আমেজ।
আরও শুনুন: পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ… এই গ্রামে থাকেন মহিলারাই, অন্তঃসত্ত্বা হন স্বেচ্ছায়
২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি নিজেদের পুরনো গ্রাহাম পেইজ গাড়িটা নিয়েই ঘর ছেড়েছিলেন এই পরিবারটি। তখন অবশ্য পরিবার বলতে শুধু দুজন। ১৯২৮ সালের সেই গাড়িটি নিয়েই বিশ্বসফরে বেড়িয়ে পড়েছিলেন হারমন ও ক্যান্ডেলেরিয়া। তার পর দুই থেকে ছয় হয়েছেন তাঁরা। ইতিমধ্যেই পেরিয়ে এসেছেন ১০২টি দেশ। প্রায় ২২ লক্ষ পাঁচ হাজার মাইল রাস্তা পেরিয়েছেন সফরে। শেষ পর্যন্ত ২২ বছর পর নিজের শহর বুয়েনোস আইরেসে এসে ভিড়েছে তাঁদের বছর পুরনো গাড়িটি।
এই যাত্রাপথেই দম্পতি বড় করেছেন নিজেদের চার সন্তানকে। যখন বিশ্বভ্রমণ শুরু করেছিলেন তখন হারমন ছিলেন ৩১ বছরের। ক্যান্ডেলিরা মাত্র উনত্রিশের। আজ তাঁরা দুজনেই পেরিয়েছেন পঞ্চাশের কোঠা। পথেই জন্ম দিয়েছেন চার সন্তানের। চার জনের রয়েছে আলাদা আলাদা দেশের নাগরিকত্ব। তাঁদের প্রথম সন্তান পাম্পার জন্ম হয়েছিল আমেরিকায়। আজ তাঁর বয়স ১৯। দ্বিতীয় সন্তান, ১৬ বছরের তেহুয়া জন্মায় আর্জেন্তিনায়। ১৪ বছরের পালোমা কানাডায় ও ১২ বছরের ওয়ালাবির জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। সব মিলিয়ে কম রঙিন নয় হারমন-ক্যান্ডেলিরার জীবনখানা। তাঁদের সঙ্গে পথে পথে ঘুরেই বড় হয়েছে চার ছেলেমেয়ে। দেখতে শিখেছে দুনিয়াখানা।
ভাবছেন তো, কেন এমন আজব বিশ্বভ্রমণের শখ? পোকাটা নড়েছিল নাকি বিয়ের পাঁচ-ছ বছর আগেই। আলাস্কায় ঘুরতে গেছিলেন হারমন ও ক্যান্ডেলিরা। সেইবার ঘুরতে ঘুরতেই তাঁদের মনে হয়, সত্যি যদি এমন কিছু করা যেত! বাধাহীন ভাবে ঘুরেবেড়ানো যেত দুনিয়া জুড়ে।
তাঁদের এই গোটা যাত্রাপথের বাহন যে গাড়িটি, সেটার নাম ছিল তখন গ্রাহাম পেইজ। আজ অবশ্য গাড়িটি আর বাজারে পাওয়া যায় না। সেই অর্থে একে ভিনটেজই বলা চলে। অদ্ভুত আকারের জন্য গাড়িটি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি মার্কেটে। গাড়ির আসনগুলোও যে বিশেষ আরামদায়ক তা-ও নয়। এমন কী শীতাতপ যন্ত্র পর্যন্ত নেই গাড়িটিতে। তবে সেটিকে নিয়েই বিশ্বপরিক্রমা করে এসেছেন হারমনের পরিবার। বাচ্চাদের প্রয়োজনমতো গাড়িতে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছিলেন হারমন। তবে গাড়ির চাকার টায়ার পাল্টানো ছাড়া বিশেষ কিছু মেরামতির কাজ করতে হয়নি এই ২২ বছরে।
আরও শুনুন: নতুন দেশের রাজা হলেন দুই বন্ধু! রেস্ত নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে কিনে ফেললেন একটা গোটা দ্বীপ
এই ২২ বছরে কেমন ছিল জীবনখানা? কতখানি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এই দীর্ঘ যাত্রাপথে। জানা গিয়েছে, এই ২২ বছরে একবার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন হারমন। আফ্রিকায় গিয়ে পরিবারের বাকিদের চেপে ধরেছিল ইবোলা ভাইরাস। মধ্য আমেরিকায় গিয়ে ডেঙ্গিতেও আক্রান্ত হন। তবে ভয় পাননি তাঁরা কোনওদিনই। বার্ড ফ্লু সংক্রমণের সময়েও গাড়ি চালিয়েছেন হারমনরা।
এত দেশে দেশে ঘুরতে তো পকেটের রেস্তোও প্রয়োজন। সঞ্চিত টাকা শেষ হওয়ার পরে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে টাকা জোগার করেছেন তাঁরা। ‘ক্যাচিং আ ড্রিম’ নামে একটি বই লেখেন দম্পতি। সেই বইয়ের এক লক্ষ কপি বিক্রি করতেও সফল হয়েছেন তাঁরা। সেখান থেকেই মূলত উঠে এসেছে ঘোরার টাকা। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নপূরণ হয়েছে দম্পতির। বিশ্বভ্রমণের সাধ মিটেছে।
২২ বছর ধরে অনেক তো হল। আপাতত এবার থিতু হয়ে বসতে চাইছেন হারমনের পরিবার। মন দিতে চাইছে সংসারজীবনে। বিশেষত বাচ্চারা। এতদিন মায়ের কাছেই যতটুকু শেখার, শিখেছে তাঁরা। এবার বাকি বাচ্চাদের মতোই স্বাভাবিক জীবন চায় তারা। স্কুলে যেতে চায়। বন্ধুবান্ধব চায়। যা এতবছরের জীবনে অবাস্তব বলেই মনে হত তাঁদের।
তবে এতদিন ধরে যে চলমান জীবনে অভ্যস্ত হয়ে এসেছে তাঁরা, সে সব ছেড়ে থিতু জীবনে কতটা মানিয়ে নিতে পারবে তো হারমন পরিবার, সেটাই এখন তাঁদের কাছে সব চেয়ে বড় প্রশ্ন।