কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। সে কথাকেই এমন করেও বলা যায়, দেশে দেশে, রাজনৈতিক শক্তিরা যুদ্ধ বাধায়। আর তার বলি হয় শিশুরা। নিজেরা মরে গিয়ে, কিংবা প্রিয়জনদের হারিয়ে। যুদ্ধের দেশ বদলায়, কিন্তু শিশুদের মা হারানোর গল্প বদলায় না।
যুদ্ধ মানেই বাতাসে বারুদের গন্ধ। যুদ্ধ মানেই মৃত্যুদূতের মতো ছুটে আসা গোলাগুলি। যুদ্ধ মানেই মৃত্যুর বুলেটিন। সভ্যতা যতই উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাক, এখনও সে লিখে চলেছে যুদ্ধের ইতিহাস। আর সেই যুদ্ধের আগুনে তছনছ হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া, ভালবাসা আনন্দ দুঃখের সব গল্প। পুড়ে যাচ্ছে শৈশবও। দেশে দেশে কালে কালে শিশুদের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অনিবার্য পরিস্থিতির মধ্যে এনে দাঁড় করাচ্ছে এক-একটা যুদ্ধ। সম্প্রতি নতুন করে যার পরিচয় দিল ইরান-ইজরায়েলের দ্বন্দ্ব।
আরও শুনুন:
যে শহরে শিশু নেই, সেখানে বড়দিন আসে না
বিগত কয়েক বছর ধরে গোটা বিশ্বে নানাদিকে যুদ্ধ চলছে। সেখানে সংকট, দ্বন্দ্ব জারি ছিল অনেক আগে থেকেই, তবে সাম্প্রতিক কালে সেসব এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে তার আঁচ এড়িয়ে থাকতে পারছে না বাকি দুনিয়াও। সে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ হোক, কি ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে গাজার উপরে লাগাতার হামলা, লেবাননে যুদ্ধ পরিস্থিতি, বা একেবারে টাটকা ইরান-ইজরায়েলের যুদ্ধ। বিশেষ করে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন-ইরানের চাপানউতোরে মধ্য প্রাচ্যের আকাশে ঘনিয়ে উঠেছে যুদ্ধের মেঘ। একদিকে ইজরায়েলের রাজধানী তেল আভিভকে নিশানা করছে তেহরান, তো পালটা জবাব দিতে প্যালেস্তাইনের শরণার্থী শিবির বা লেবাননের সেনা হাসপাতালে হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েল। এই পরিস্থিতিতেই জানা গেল, তেল আভিভে গুলিবর্ষণের মাঝে শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারালেন এক মা।
শোনা যাচ্ছে, হামাসের তরফে দুই বন্দুকবাজ তেল আভিভের এক রেলস্টেশনে লাগাতার গুলি চালায়, ছোরার ঘায়েও লোকজনকে জখম করতে থাকে। সেখানেই আটকে পড়েছিলেন সদ্য মা হওয়া এক তরুণী। ইনবার সেগেভ-ভিগডের নামের ওই তরুণীর বয়স বছর ৩৩। নিজের ৯ মাসের শিশুপুত্রকে সর্বশক্তি দিয়ে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি, যাতে গুলি কিংবা ছোরা তাকে স্পর্শ করতে না পারে। সেই অবস্থাতেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। শিশুটি রক্ষা পেয়েছে বটে, তবে এই বয়সেই মাকে হারাল সে।
আরও শুনুন:
৭০০ শিশুকে হিটলারের থাবা থেকে বাঁচিয়েছিলেন একাই, জানেন কে ইনি?
সত্যি বলতে, এই শিশুটি একা নয়। ঠিক যেমন, এই তরুণীও একা নন যিনি এভাবে যুদ্ধের বলি হলেন। যুদ্ধ বাধে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, কিন্তু তার অভিঘাতে তছনছ হয়ে যায় সাধারণ দেশবাসীর জীবন। যুদ্ধ তাদের কাউকে শিকড় থেকে উৎখাত করে দেয়, কাউকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের পরিবার পরিজনের কাছ থেকে, আর কারও জীবনটাই ফুরিয়ে যায় যুদ্ধের আগুনে। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় যেমন ইউনিসেফ জানিয়েছিল, প্রতি মিনিটে উদ্বাস্তু হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ৫৫ জন শিশু, অর্থাৎ সংখ্যাটা পৌঁছে গিয়েছিল সেকেন্ডে প্রায় একজনে। বিধ্বস্ত গাজাতেও দেখা গিয়েছে, স্কুল, হাসপাতাল, শেল্টার, যে কোনও জায়গায় আছড়ে পড়ছে ইজরায়েলের মিসাইল। ফলে কেবল উদ্বাস্তু হওয়া বা অনাথ হওয়াই নয়, প্রাণও হারাচ্ছে অসংখ্য শিশু। সেখানে যে ইজরায়েল ছিল ঘাতক, সেই ইজরায়েলেও কিন্তু একইভাবে পালটা হামলায় আহত হচ্ছে। সেখানে প্রাণ হারাচ্ছেন এই তরুণীর মতো অনেক মা। মা হারাচ্ছে শিশুরা, শিশুদের হারাচ্ছেন মা- যাদের কারোরই জীবনটা আসলে এমন শূন্য হয়ে যাওয়ার কথা ছিল না।
যুদ্ধের অনিবার্য ফল হয়ে আসে মানুষের প্রাণহানি। যে শিশুদের জীবন অকালেই বদলে নিল মানুষেরই তৈরি করা যুদ্ধ, তাদের অসহায় মুখগুলি কি যুদ্ধ বন্ধ করার যথেষ্ট কারণ নয়?