না ঘুমিয়ে যদি লাগাতার ডিউটি করতে হয় ট্রেনের চালককে, তবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। নিজের কাজ ঠিকমতো করার জন্য যে কোনও কর্মীরই পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজন। আর সেই দাবিতেই প্রথমবার রেল রোকো হয়েছিল ভারত জুড়ে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর রেল কর্তৃপক্ষের অভিযোগের আঙুল মালগাড়ির চালকের দিকে। সে অভিযোগের পালটা দিয়ে রেলকর্মীদের একাংশই বলছেন, কীভাবে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ছাড়াই লাগাতার ডিউটি করা তাঁদের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালগাড়ির সহকারী চালকের স্ত্রীও দাবি করেছেন, দীর্ঘদিন রেলে নিয়োগ না হওয়ায় চালক ও সহকারী চালকের সংখ্যা রুটে চলা ট্রেনের তুলনায় অনেকটাই কম। ফলে দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে, বিশ্রাম না নিয়ে টানা ৭০-৭২ ঘণ্টা চালকদের ডিউটি করতে বাধ্য করছে রেল কর্তৃপক্ষ। বস্তুত এক্ষেত্রেও মালগাড়ির চালককে টানা ডিউটির পর কার্যত ঘুম থেকে তুলেই ফের ডিউটিতে পাঠানো হয়েছিল। অথচ যথাযথ ভাবে নিজের কাজ করতে হলে যে কোনও মানুষেরই যে নিয়মিত বিশ্রামের প্রয়োজন, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এসব ক্ষেত্রে কাজে ভুল মানেই রয়ে যায় নিজের এবং আরও অনেক মানুষের প্রাণের আশঙ্কাও। তাই বিশ্রাম, তথা কাজের সময় নির্দিষ্ট করার দাবিতেই দেশ জুড়ে রেল ধর্মঘট দেখেছিল ভারত।
আরও শুনুন:
বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে! রেলের পুরনো আমলেও কি এ কথাই ভেবেছিল ভারত?
সেটা ১৯৭৪ সালের ৮ মে। সেদিন ভোরে উঠেই দেশ দেখেছিল, অসাড় করে দেওয়া হয়েছে তাকে। কারণ গোটা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে রেল রোকো। ইতিহাস বলে, ২০ দিন ধরে চলেছিল এই ধর্মঘট। All India Railwaymen’s Federation-এর ডাকে ১৫ লাখের বেশি রেলওয়ে কর্মীরা এই ধর্মঘটে শামিল হন। আর তার ফলে গোটা দেশেই একসঙ্গে থেমে যায় সবরকম ট্রেনের চলাচল। ধর্মঘটীদের প্রাথমিক দাবিই ছিল বিশ্রামের। তাঁরা দাবি করেছিলেন, শ্রম আইন অনুসারে দিনে আট ঘণ্টা কাজ করার যে নিয়ম নির্দিষ্ট রয়েছে, সেই নিয়ম প্রযোজ্য হোক তাঁদের ক্ষেত্রেও। বোঝা যায়, সে সময়েও বাড়তি ডিউটির চল ছিল ভালোমতোই। এর সঙ্গে জুড়েছিল বেতন নিয়ে অসন্তোষও।
আরও শুনুন:
মোদি সরকারের আমলে ৬০০ পেরোল রেল দুর্ঘটনা, কংগ্রেস যুগে সংখ্যাটা কত ছিল?
ভারতীয় রেলে ধর্মঘট অবশ্য নতুন কথা নয়। ব্রিটিশ আমলেও কখনও বেতন, কখনও শ্রমিকদের উপর হওয়া দমননীতি, যৌন হেনস্তা, এমন নানা কারণে বিক্ষোভে নেমেছেন রেলকর্মীরা। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে জাপানি বোমার ভয়, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক হিংসার মতো নানা কারণেই কাজ বন্ধ করেছেন তাঁরা। যদিও শ্রমিকদের আন্দোলনকে কোনও দিনই ভালো চোখে দেখেনি প্রশাসন। স্বাধীন ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৭৪-এর ধর্মঘটকে কড়া হাতে দমন করে সেকালের ইন্দিরা গান্ধী সরকার। All India Railwaymen’s Federation-এর তৎকালীন সভাপতি জর্জ ফার্নান্ডেজকে জেলে পোরা হয়। তবে তা সত্ত্বেও যে দেশ জুড়ে ধর্মঘট করেছিলেন রেলকর্মীরা, স্বাধীন দেশের গণতন্ত্রকে পরখ করে নেওয়ার জন্যে তা জরুরি ছিল বইকি। ভারতের শ্রম আন্দোলনের ইতিহাসেই এক জরুরি অধ্যায় হয়ে থেকে গিয়েছে এই রেল রোকো।