গান্ধীর ছবিওলা নোট আর অশোক স্তম্ভের ছবি-সহ পয়সা তো সকলেই চিনি। কিন্তু জানেন কি, একসময় এই দেশেই মিলত এমন এক মুদ্রা, যাতে খোদাই করা থাকত রাম-সীতার মূর্তি? এক মুঘল সম্রাটের আমলেই চালু হয়েছিল হিন্দু অবতারের ছবি দেওয়া এই মুদ্রা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মুদ্রার এক পিঠে রয়েছেন শ্রীরামচন্দ্র। তাঁর হাতে তির-ধনুক। তাঁর সঙ্গেই পদ্ম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সীতাও। আর মুদ্রার উপরদিকে দেবনাগরী অক্ষরে রাম-সীতার নাম খোদাই করা। এক ফেলে আসা সময়ে এমনই এক মুদ্রার চল ছিল দেশে।
রামের মুখে শরিয়ত, কখনও তিনিই রাম হায়দার… রামকথাকে নানাভাবে খুঁজেছেন মুসলিমরাও
ফেলে আসা সময়ই বটে। যে দেশে মাঝে মাঝেই ধর্মকে কেন্দ্র করে ঘনিয়ে ওঠে বিরোধ, সেখানে কি আর ভাবা যায় যে, একদিন হিন্দু অবতারের ছবি-সহ এই মুদ্রা চালু করেছিলেন এক মুসলিম সম্রাট? হ্যাঁ, কোনও রামভক্ত হিন্দু রাজা তাঁর ঈশ্বরের নামে মুদ্রা চালু করেছিলেন, এমনটা নয় কিন্তু। মুঘল সম্রাট আকবরের উদ্যোগেই চালু হয়েছিল এই বিশেষ মুদ্রা। জানা যায়, মুঘল বংশের প্রথম দুই সম্রাট বাবর ও হুমায়ুনের আমলে যে মুদ্রা চালু ছিল, তাদের বলা হত শাহরুখি মুদ্রা। রুপোয় তৈরি এই মুদ্রায় খোদাই করা থাকত কোরানের আয়াত, সঙ্গে থাকত ইসলামের প্রথম চার খলিফা এবং সম্রাটের নাম। আকবর মসনদে বসার পরও এই শাহরুখি মুদ্রাই চালু ছিল। তাহলে আকস্মিক ভাবে কেন এই নতুন মুদ্রা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সম্রাট?
-: আরও শুনুন :-
বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে শতাধিক রামায়ণ, রামকে কেন্দ্র করেই জারি ভিন্নমতের অধিকারও
আসলে এর নেপথ্যে রয়েছে আকবরের সেই সর্বধর্ম সমন্বয়ের লক্ষ্যটিই। কোনও একটিমাত্র ধর্মকে প্রাধান্য না দিয়ে, সব ধর্মের থেকেই মনুষ্যত্বের শিক্ষা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন এই মুসলিম সম্রাট। আর সেই উদ্দেশ্যেই নতুন ধর্মমত দিন-ই-ইলাহি চালু করেছিলেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি চালু করেন ইলাহি ক্যালেন্ডার ও ইলাহি মুদ্রা। তাঁর রাজত্বের শেষ বছরে, অর্থাৎ ১৬০৫ সালে এই ইলাহি মুদ্রাতেই খোদাই করা হয় রাম-সীতার ছবি। একে তো রাম সীতার উপাসনা করেন হিন্দু ধর্মের মানুষেরা। ভিনধর্মের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতেই অভ্যস্ত হিন্দুদের একটা বড় অংশ। তার উপরে ইসলাম ধর্মেও মূর্তি গড়া ধর্মবিরুদ্ধ। সেই প্রেক্ষিতে মুদ্রায় ভিন্ন ধর্মের দেবতাকে ঠাঁই দেওয়া রীতিমতো সাহসের কাজ। সত্যি বলতে, আকবরের আমলেও এগুলিই একমাত্র মুদ্রা যাতে মানুষের দেহের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এখন অবশ্য এই মুদ্রার কোনও নিদর্শনও দেখতে পাওয়া সহজ নয়। জানা যায়, কয়েক বছর আগে খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল একটি রুপোর ইলাহি মুদ্রার। নিলামে যার দাম উঠেছিল ১ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
এই সময়ের পৃথিবীতে সমন্বয় আর সম্প্রীতিই বহুমূল্য হয়ে উঠেছে, হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্লভও। ঠিক ওই মুদ্রার মতোই। কিন্তু ধর্মের নামে বিভেদ নয়, সমন্বয়ের বার্তাই শুনিয়েছিল এক কালের ভারতবর্ষ। ইতিহাস ছুঁয়ে সে কথাই এখন মনে করে নেওয়া জরুরি।