রাজধানী শহর দিল্লি। তবে সেখানে বিশুদ্ধ বাতাস শব্দটার কোনও অস্তিত্ব নেই আর। কারণ এই শহরেই দূষণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বিষ মেশানো বাতাস মানুষকে ক্রমশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। শুধু শ্বাসজনীত সমস্যাই নয়, মেয়েদের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলছে এই দূষণ। ক্ষতি হচ্ছে গর্ভস্থ ভ্রূণেরও। সম্প্রতি একটি গবেষণায় ধরা পড়েছে এমনই তথ্য। কী বলছেন বিশেষজ্ঞেরা? শুনে নিন।
করোনা কাঁটায় আমাদের কেটে গিয়েছে তিন-তিনটি বছর। অতিমারি কেড়েছে আমাদের প্রিয়জন, বদলে দিয়েছে জীবনটাকেই। সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরার অভ্যেস শিখিয়েছে করোনা। কিন্তু করোনার অনেক আগে থেকেই কিন্তু দিল্লিবাসীর মুখে উঠেছে মাস্ক। তাঁর কারণ মারাত্মক বায়ুদূষণ। আর সেখানকার বায়ুতে বিষের পরিমাণ এতটাই বেশি যে দিল্লিকে একটা আস্ত গ্যাসচেম্বার বললেও ভুল হবে না।
করোনা যদি সরাসরি মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে, বাতাসের এই বিষ তাহলে ‘সাইলেন্ট কিলার’। ধীরে ধীরে মানুষের শরীরে ঢুকে তা মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অবিরত। গোটা বিশ্বে প্রতিবছর অন্তত ৭০ লক্ষ মানুষের প্রাণ কাড়ছে এই দূষণ। যে সংখ্যাটা বেশ ভয়েরও। সামগ্রিক ভাবে ভারতের অবস্থাই পরিবেশ দূষণের নিরিখে বেশ শোচনীয়। তবে দূষণের দিক দিয়ে গোটা বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে দিল্লিই।
আরও শুনুন: শুধু পরিবেশেই নয়, রক্তেও বিষ ঢালছে মাইক্রোপ্লাস্টিক! হতে পারে মারাত্মক ক্ষতি
বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসের সমস্যা, ফুসফুসের ক্ষতি- এসব তো রয়েইছে। তবে বিষাক্ত বাতাসের সব চেয়ে বেশ প্রভাব পড়ছে নাকি মহিলা ও শিশুদের উপরেই। বায়ুদূষণের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মেয়েদের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা। বাড়ছে গর্ভপাত, গর্ভাবস্থাকালীন সমস্যা। শুধু তাই নয়, এর প্রভাব পড়ছে গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠনেও। সম্প্রতি একটি গবেষণায় ধরা পড়েছে এই তথ্য।
বহু সময়েই গর্ভাবস্থায় বেশ কিছু জটিলতা দেখতে পাই আমরা। উচ্চরক্তচাপ, জেস্টাশ্যানাল ডায়েবিটিসের মতো বেশ কিছু সমস্যাও দেখা যাচ্ছে আজকাল। এমনকি গর্ভপাতের ঘটনাও দিন কে দিন বাড়ছে। এসবের পিছনে একটি অন্যতম বড় কারণ কিন্তু এই বিষাক্ত বাতাস। বস্টনের একটি হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট পল্লবী পান্তে জানিয়েছেন, এমনকি ডেলিভারির সময় শিশুর মৃত্যুরও কারণ হতে পারে এই দূষণ। সব মিলিয়ে গর্ভবতী মহিলাদের উপরে বড়সড় প্রভাব ফেলছে এই বাড়তে থাকা বায়ুদূষণ। বেশ কয়েকটি গবেষণায় এ-ও প্রমাণিত হয়েছে, বায়ুদূষণের ফলে মেয়েদের সন্তানধারণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি গর্ভাবস্থায় ডিপ্রেশনের পিছনেও থাকছে এই দূষণেরই প্রভাব।
এই দূষণ যে শুধু ঘরের বাইরে তা কিন্তু নয়। বাতাসে বিষ ছড়াচ্ছে ঘরের ভিতর থেকেও। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা বহু এলাকেই রান্নার জন্য আজও কাঠকয়লার মতো জ্বালানি ব্যবহার হয়। সেখান থেকেও প্রচুর পরিমাণে দূষণ ছড়ায় বাতাসে। সব চেয়ে বড় কথা, বাড়ির মহিলাদের কিন্তু দিনের একটা বড় সময় কাটছে ওই আগুনের সামনেই। শুধু ভারতেই ৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ঘরের ভিতরের দূষণ থেকে।
প্রতিবছরই পাল্লা দিয়ে খারাপ হচ্ছে পরিস্থিতি। আমরা যে বাতাসে প্রতিমুহূর্তে শ্বাস নিচ্ছে, তা কবেই পেরিয়ে গিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা নির্ধারণ করে দেওয়া দূষণের সীমা। ২০২০ সালের গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট জানাচ্ছে, গত কয়েক দশকে ভারত ও নেপালে বায়ুতে দূষণের মাত্রার তেমন উন্নতি হয়নি। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া এলাকায় প্রতিবছর ৭ শতাংশ গর্ভপাতের কারণই নাকি এই বায়ুদূষণ।
আরও শুনুন: আকাশ থেকে মাছ বৃষ্টি হয় প্রতিবছর, আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী থাকে এই শহর
পরিবেশ দূষণের ফলে বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। বাড়ছে উষ্ণায়ন। ক্রমশ গলে যাচ্ছে মেরুপ্রদেশের বরফ। অবস্থা যে দিকে গেছে, তাতে পৃথিবীর আয়ু সংকটের মুখে। আর এই ক্রমাগত বাড়তে থাকা বায়ুদূষণ সেই প্রক্রিয়াকেই আরও ত্বরান্বিত করছে। ফলে এখনও যদি সাবধান না হওয়া যায়, তবে বিপদের আরও কাছাকাছি পৌঁছে যাব আমরা।
গাড়িঘোড়া, ট্র্যাফিক, নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা, পুকুর বুজিয়ে কংক্রিটের শহর বানানো, দূষণের পিছনে এসব অজস্র কারণ তো রয়েছেই। তবে ঘরের ভিতর থেকে ছড়ানো দূষণ আটকানো গেলেও বায়ুদূষণের মাত্রা অনেকটাই কমানো যাবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। আর তা করতে পারলেই মহিলা ও শিশুদের এই সমস্যা থেকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব বলেই মনে করছেন তাঁরা।