এক বয়সে ছিলেন নেহাতই বেঁটেখাঁটো। তার জন্য বাদ পড়েছিলেন সেনা থেকেও। তবে সেই মানুষই কিনা হয়ে উঠলেন আকাশছোঁয়া লম্বা। তিনিই পৃথিবীর প্রথম মানুষ, যে কিনা একাধারে ছিলেন খর্বকায় ও পরে দৈত্যাকার উচ্চতার অধিকারী। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আজও এক আশ্চর্য এই ব্যক্তির জীবন। শুনে নিন, তাঁর গল্প।
একটা বয়স পর্যন্ত ছিলেন ছোট্টখাট্টো একটা মানুষ। উচ্চতায় খাটো বলে কম অসবিধায় পড়তে হয়েছে তাঁকে! এমনকি হাতছাড়া হয়েছিল সেনাবাহিনীর চাকরিখানাও। কিন্তু একদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখলেন ম্যাজিক। কোথায় সেই ছোটখাটো মানুষ? আয়নার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে, তিনি দৈত্যের মতো লম্বা।
এমন আবার হয় নাকি! বিশ্বাস না হলেও এ কথা সত্যি, যে তিনিই ছিলেন ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি, যিনি এক জীবনে ছিলেন খর্বকায়ও, আবার দৈত্যাকারও। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অ্যাডামের এই বিরল অবস্থার ব্যাখ্যা পাওয়া ছিল অসম্ভব।
আরও শুনুন: পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ নাকি ইনি! রাক্ষুসে খিদের কারণেই হয়েছিলেন গুপ্তচরও
১৮৯৯ সালে অস্ট্রিয়ার গ্রাজ শহরে জন্ম অ্যাডাম রেইনার নামে ওই ব্যক্তির। বেঁটেখাটো চেহারা থেকে রাতারাতি দৈত্যাকার এক মানুষ, এর ফাঁকে পড়েই কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল অ্যাডামের ব্যক্তিগত জীবনটা। সেসব খবর আর কেউ রাখেনি।
অ্যাডামের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন স্বাভাবিক উচ্চতাসম্পন্ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যান অ্যাডাম। সে সময় তাঁর উচ্চতা ছিল মাত্র ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। সেনাবাহিনীর ডাক্তাররা তাঁকে প্রথম দর্শনেই ‘বামন’ বলে দাগিয়ে দেন। দুর্বল বলে বাদ পড়েন সেনার চাকরি থেকে। তবে আশা ছাড়েননি অ্যাডাম। পরের বছর উচ্চতা দু ইঞ্চি বাড়িয়ে ফের সেনার পরীক্ষায় বসে পড়লেন তিনি। যা হওয়ার তাই হল। তখন তাঁর বয়, ১৯ বছর। সে সময়েও তাঁর উচ্চতা ছিল ৪ ফুট ৮ ইঞ্চি। পাশাপাশি খুব রোগাও ছিলেন অ্যাডাম। ফলে এ বারও অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলেন তিনি।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, উচ্চতায় খাটো হলেও হাত পা গুলি আশ্চর্য রকমের লম্বা লম্বা ছিল অ্যাডামের। প্রথম বার সেনার পরীক্ষায় বসার সময় তাঁর জুতোর মাপ যা ছিল, দ্বিতীয়বার ছিল তার প্রায় দ্বিগুণ। এত কম উচ্চতার কোনও ব্যক্তির এত বড় পা! এমনটা কিন্তু সচরাচর দেখা যায়না।
আরও শুনুন: সদ্যোজাতর নাম রাখাই পেশা, উপার্জনের অঙ্কে চমক লাগছে নেটিজেনদের
তবে সমস্যাটা বোঝা গেল কদিন পরে। ২১ বছর বয়সের পর সাধারণ ভাবে মানুষের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। তবে ওই বয়সের পরেই মারাত্মক ভাবে বাড়তে শুরু করলেন অ্যাডাম। ১৯৩২ সাল নাগাদ দেখা গেল অ্যাডামের উচ্চতা প্রায় ৭ ফুট ২ ইঞ্চি। তখন তাঁর বয়স ৩৩। সেই সঙ্গে দেখা গেল, বেঁকে যেতে শুরু করেছে অ্যাডামের শিরদারার বেশ কিছুটা অংশ। অ্যাডামের আচমকা এমন বৃদ্ধি দেখে অবাক হয়ে যান চিকিৎসকেরাও।
অবশেষে বেশ কিছু পরীক্ষানিরিক্ষার পরে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে অ্যাক্রোমেগালি নামে এক বিশেষ রোগে ভুগছিলেন অ্যাডাম। কী সেটা? চিকিৎসকেরা জানান, অ্যাডামের পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের উপরে দীর্ধদিন ধরেই বেড়ে উঠেছিল একটি টিউমার। আর তার জন্যই হরমোনাল ডিজঅর্ডারের শিকার হন অ্যাডাম। গ্রোথ হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের ফলেই বেঁটেখাটো আদম রাতারাতি এমন লম্বা হতে শুরু করেন। বিখ্যাত রেসলার আন্দ্রে দ্য জায়েন্ট থেকে দ্য গ্রেট খালি, অনেকেই এই বিশেষ রোগের শিকার।
অ্যাডামের ওই টিউমারটি কেটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। বেশ ঝুঁকির অস্ত্রোপচার ছিল সেটি। সৌভাগ্যক্রমে সফলও হন তাঁরা। ঝড়ের গতিতে বৃদ্ধি রুখে দেওয়া গেলেও অ্যাডামের শিরদাড়ার বৃদ্ধি কিন্তু আটকানো যায়নি। তবে কমেছিল গতি। তবে মেরুদণ্ডটি বেঁকে যেতে যেতে এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, যে বাকি জীবনটা বিছানালগ্ন হয়েই কাটাতে হয়েছে অ্যাডামকে। শেষজীবনে হারিয়ে ফেলেছিলেন দৃষ্টি ও শ্রবণক্ষমতা। ১৯৫০ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি। সে সময় তাঁর উচ্চতা ছিল ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি। তবে অ্যাডামই ইতিহাসের প্রথম মানুষ যিনি একাধারে ছিলেন খর্বকায়, এবং পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন দৈত্যাকার উচ্চতার অধিকারী।