হাঁটার দিনের সঙ্গে আমাদের কতটুকু সখ্য আছে কে জানে! অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তি দিতেই এই হাঁটার আয়োজন। তবে, এমন কিছু অসুখ আছে দেশের গভীরে, যা থেকে সহজে মুক্তি মেলে না। সেই দেশের দিকে তাকাতে আমাদের দ্বিধা হয়। ভয়ও করে। আর সেই সব মুহূর্তে কান পাতলে শোনা যায়, কেউ একজন ডাক দিয়ে বলছেন, ‘হেঁটে দেখতে শিখুন ঝরছে কী খুন দিনের রাতের মাথায়’।
হাঁটার দিনের সঙ্গে বাঙালির তেমন ঘনিষ্ঠতা থাক বা না-থাক, জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে আছে। হাজার বছর পথ হাঁটার শেষেই দু-দণ্ড বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার ফুরসত মেলে। সেই ফুরসতেই মুক্তি পায় বাংলা ভাষা আর কবিতা। অতএব বাঙালি জানে পরিক্রমার মর্ম। লেনিন তাই আদৌ বলুন বা না-বলুন, বাঙালি জানে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ডাক দিয়ে বলছেন, ‘শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে/ একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে।’ পা চালিয়েই এগোলেই চরৈবেতি। নবজাগরণের বাংলা ও বাঙালি সে মন্ত্র ভুলবে কেমন করে!
আরও শুনুন:
তবু বোকা রয়ে যাই বারবার… | অর্পণ গুপ্ত
বাঙালি তাই তার ঈশ্বরকেও ডেকে নেয় পদচিহ্নেই। ছাপ ফেলে ফেলে ঘরে আসে সৌন্দর্য আর সমৃদ্ধি। আলপনায় ফুটে ওঠে সেই ডাকের বাসনা। সেই অমোঘ মণীন্দ্র গুপ্ত- “পুরুতঠাকুর পুজো শেষ করে চলে গেলেন, তখনও আমি বসে আছি। ফুটফুট করছে আমাদের উঠোন। চাঁদের আলোয়, মাটির দাওয়ায় আলপনা ফুটে আছে স্পষ্ট হয়ে। আকাশ, বাতাস, দশদিক বড় নিথর, নীরব আর শীতল। জ্যোৎস্নাধূসর গাছপালার পল্লবের উপরটায় আলো পিছলে যাচ্ছে, ভিতরে ভিতরে কালো ছায়া। বসে থেকে থেকে স্পষ্টই বুঝি, সব মিথ্যে কথা – সোনার গয়না পরা, বালুচরী শাড়ি পরা সেই দেবীকিশোরী কখনোই আসবেন না আমাদের বাড়িতে। আর যদি বা আসেন, তেঁতুলতলা দিয়ে আসতে আসতে তাঁর পায়ে ধুলো লেগে যাবে, পশ্চিমপুকুরপাড়ের রাস্তায় অন্ধকারে তাঁর গয়না হারিয়ে যাবে, আমাদের বাড়ির দরজায় যখন পৌঁছবেন তখন তাঁর শাড়ি ছোটমার শাড়ির মতো ময়লা।” আমরা দেখতে পাই, যিনি হেঁটে আসেন, তিনি দেবী নন। তিনি মেঘে ঢাকা তারা; নীতা; যে জগদ্ধাত্রীর জুতোর ফিতে ছিঁড়ে নেয় খরখরে সময়, তবু হাঁটা থামে না। হাঁটার বিরাম থাকতে নেই। যে স্বাধীনতা সৌভাগ্য হয়ে ওঠার কথা ছিল, তাই-ই তো এনেছিল দেশভাগ। ফলত উচ্ছিন্ন হওয়ার নিয়তি আর এই হাঁটা- “পেরিয়ে পেরিয়ে উঁচু, নিচু, ঢালু মাঠ/ শিশির ভেজানো কাঁটাতার, গাছপালা/ আলপথে নেমে আমরা যাচ্ছিলাম/ ধানক্ষেত ভেঙে আমরা যাচ্ছিলাম।” রাজনীতির কোপে দেশ বদলে যায়। মানুষের বেঁচে থাকার গল্পগুলো বদলায় না। হাঁটতেই হয়।
আরও শুনুন:
ভাবলে ভুল হবেই…তাতে ভাবনা বন্ধ হবে কেন?
একদিন স্বাধীন দেশ সব কিছু ভুলে কিংবা স্মৃতিতে জমা রেখে এগিয়ে যায়। ধুলোপথ পাকা পিচ ঢালা হয় উন্নতিতে। সেই পথেই এসে পড়ে বিশ্বায়ন। দেশের ভিতর বদলে যায় দেশ। সংঘ ভেঙে যায়। ভেঙে যায় সংগঠিত ক্ষেত্র। অসংগঠিত ছাতার তলায় তলায় দাঁড়িয়ে মানুষ আটকে পড়ে নিজের ঘেরাটোপে। পাশের মানুষ চলে যায় আলোকবর্ষের থেকেও দূরে। পরস্পরের দিকে আর হেঁটে যাওয়া হয় না বহুদিন। সোশ্যাল মিডিয়ার সান্ত্বনা এসে ভুলিয়ে রাখে সবকিছু। তার পর একদিন আসে করোনা। নেমে আসে লকডাউন। আর বিস্মিত দেশ দেখে, আবার হাঁটছে মানুষ। তাদের জন্য গাড়ি নেই, ঘোড়া নেই, সভ্যতা নেই। আছে শুধু পায়ে হেঁটে বাঁচার গন্তব্যে পৌঁছনোর দুরন্ত আশা। অতএব তাঁরা হাঁটছে। কেন হাঁটছে? কেন হাঁটছেন? সে সব প্রশ্ন ওঠে বটে। লেখা হয় উত্তরসম্পাদকীয়। তারপর সব মিলিয়ে যায়। শুধু জেগে স্মৃতি থাকে সেই সব হেঁটে-আসা-পায়ে। যেমন জ্বলজ্বল করে ফোস্কা। অধিকার আদায়ে যে কৃষকরমণী হেঁটে যেতে চান রাজধানীতে তাঁর পায়ের ক্ষতে হাঁটার স্মৃতি বেঁচে থাকে দ্রোহ হয়ে। বৈশ্য সমাজ সে স্মৃতিকে ব্যবহার্য করে তুলতে চায় না, কেননা তা বিপজ্জনক।
হাঁটার দিনের সঙ্গে আমাদের কতটুকু সখ্য আছে কে জানে! অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তি দিতেই এই হাঁটার আয়োজন। তবে, এমন কিছু অসুখ আছে দেশের গভীরে, যা থেকে সহজে মুক্তি মেলে না। সেই দেশের দিকে তাকাতে আমাদের দ্বিধা হয়। ভয়ও করে। আর সেই সব মুহূর্তে কান পাতলে শোনা যায়, কেউ একজন ডাক দিয়ে বলছেন, ‘হেঁটে দেখতে শিখুন ঝরছে কী খুন দিনের রাতের মাথায়’।
হ্যাঁ, হেঁটেই আমাদের সবকিছু দেখতে শিখতে হবে।