যত মত তত পথ- কী অনায়াসে এ কথা বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কোনও একটি মত, একটি আদর্শের ছকে সকলকে বেঁধে ফেলার যে আদৌ প্রয়োজন নেই, সেই উদারতার বার্তা বয়ে আনে এ কথা। যে সময়ে গোটা দেশ তেমনই কোনও একমাত্রিকতার কাঠামো নির্মাণ করতে চাইছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ওই ছকের পালটা বয়ান হয়ে উঠতে পারে শ্রীরামকৃষ্ণের এই বক্তব্যই। শুনে নেওয়া যাক।
ধর্ম আর রাজনীতি, আপাতদৃষ্টিতে দুই ভিন্ন গোলার্ধ। সাধারণভাবে দেখলে মনে হয়, শ্রীরামকৃষ্ণের যা কিছু ভাবনাচিন্তা, যা কিছু বক্তব্য, তার সবটাই তো ধর্মকে ঘিরে। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়! এই যে ‘যত মত তত পথ’-এর বার্তা, তা তো ঈশ্বরের সাধনা প্রসঙ্গেই। ভক্ত বিশ্বাস করেন, সাধন করলে ঈশ্বরের দর্শন মেলে। এই সাধনের একেকটি পথ আশ্রয় করেন একেকজন। তাতে সমস্যাও নেই। কিন্তু গোল বাধে তখনই, যখন একজন মনে করেন তাঁর পথটিই একমাত্র পথ, বাকি পথগুলি নিকৃষ্ট কিংবা অপ্রয়োজনীয়। নিজের মত অন্যদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থেকেই বাধে সংঘাত। অথচ ভিন্ন মতকে স্বীকৃতিটুকু দিলেই যে এই সংঘাতের সম্ভাবনায় জল ঢালা যায়, সে কথাই বুঝিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। খুব স্পষ্ট করেই তিনি বলেছিলেন, “আমি বলি, সকলেই তাঁকে ডাকছে। দ্বেষাদ্বেষীর দরকার নাই। কেউ বলছে সাকার, কেউ বলছে নিরাকার। আমি বলি, যার সাকারে বিশ্বাস সে সাকারই চিন্তা করুক, যার নিরাকারে বিশ্বাস, সে নিরাকারই চিন্তা করুক।” বিভিন্ন সাধনপথে সিদ্ধিলাভ করে ধর্মীয় প্রসঙ্গেই এ কথা বলেছিলেন রামকৃষ্ণ। কিন্তু ভেবে দেখা যাক, এ কথা কি বৃহত্তর ক্ষেত্রেও একইভাবে কার্যকরী নয়? অন্যের মতকে মেনে নিতে না পারা থেকেই তো সমাজের যাবতীয় বিরোধ বিবাদের উৎপত্তি। অথচ ভিন্নমতের প্রতি গ্রহিষ্ণুতা যে আসলে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতার বাতাবরণকেই স্থায়িত্ব দেবে, ‘যত মত তত পথ’-এর মধ্যে সেই বার্তাটিই জেগে রয়েছে। তাহলে যে সময়ে দাঁড়িয়ে এ দেশ ক্রমাগত একরকম একমাত্রিকতার বয়ানে ঢুকে পড়ছে, সেই সময়ে এই গ্রহিষ্ণুতার বার্তাটি কি জরুরি নয়?
আরও শুনুন:
‘আমাকে কি ত্যাগ করবেন?’ প্রশ্ন ধর্মত্যাগী মাইকেল মধুসূদনের, ঠাকুর বললেন…
সত্যি বলতে, কি সংসার কি সমাজ, কি পরিবার কি শাসক- সব ক্ষেত্রেই নিজের কথাকে সবচেয়ে বেশি মান্যতা দেওয়ার প্রবণতা সব কালেই ছিল। আরও ভালো করে বললে, যে ক্ষমতাবান, সে-ই বাকি সকলকে অপর মনে করে নিজের কথাকে একমাত্র মর্যাদা দিয়েছে। সেই জোর জোগাতে গিয়ে অনেকসময়ই অন্যদের স্বর রুদ্ধ হয়েছে। তবে বর্তমানে এই প্রক্রিয়াটিই বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্রের প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায়। ধর্মের একরকম একরৈখিক বয়ান ক্রমশ মান্যতা পাচ্ছে একমাত্রিক রাজনীতির হাত ধরেই। যেখানে অন্য মতের পরিসর ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে আসছে বলেই আশঙ্কা অনেকের। সেই প্রেক্ষিতেই যেন ধর্মের গণ্ডি ছাপিয়ে জরুরি হয়ে ওঠেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ গ্রাম্য এক পূজারি ব্রাহ্মণ হয়েও যিনি মত ও পথের ভিন্নতাকে দুহাত বাড়িয়ে স্বীকার করে নিতে পেরেছিলেন। যিনি খোলা গলায় বলতে পেরেছিলেন, ‘সব মতই পথ, মত কিছু ঈশ্বর নয়’। আর তাই অন্যের মত ভুল, এ ভাবার দরকার নেই। কারও পথ নিয়ে দ্বেষ পুষে রাখারও প্রয়োজন নেই। বস্তুত এ কথা ভারতবর্ষেরই কথা। গীতার জ্ঞানযোগে অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।
অর্থাৎ তিনি বলছেন, ‘হে পার্থ, যে আমাকে যে ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি। মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছিতে পারে।’ এও ধর্মের কথা। আবার এ কথার স্থান এক রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র। সেই পরিস্থিতিতেও মত-পথের ভিন্নতাকে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই বহুমাত্রিকতার কথাই বারে বারে বলেছে এ দেশ। সকলের বোঝার মতো সহজে সে কথাটিই বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আর তাই, যে সময়ে গোটা দেশ কোনও একমাত্রিকতার কাঠামো নির্মাণ করতে চাইছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ওই ছকের পালটা বয়ান হয়ে উঠতে পারে শ্রীরামকৃষ্ণের এই বক্তব্যই।