বলে যাওয়ার জন্যেই আসলে শোনার অভ্যাস জারি থাকাও জরুরি। কেন-না শোনা তো এক অর্থে অন্যকে বলতে দেওয়া। শোনার অভ্যাস আসলে অপরের কথা বলার অধিকারের পক্ষে নীরবে কথা বলে যাওয়া। সে অভ্যাসের আরেক নাম হতে পারে সহিষ্ণুতাই।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
“মানুষ কথা বলে যায়
কথার কথা বলে যায়
কথা বলে কথা না শুনে
কথা শোনে কথা না শুনে”…
ক্রমাগত কথা বলে গেলে যে সে কথারা ক্রমশই মূল্য হারায়, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন নাগরিক কবিয়াল। মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, স্তব্ধতার গানও মানুষকে শুনতে হয় কখনও কখনও। বলে যাওয়ার জন্যেই আসলে শোনার অভ্যাস জারি থাকাও জরুরি। কেন-না শোনা তো এক অর্থে অন্যকে বলতে দেওয়া। শোনার অভ্যাস আসলে অপরের কথা বলার অধিকারের পক্ষে নীরবে কথা বলে যাওয়া। সে অভ্যাসের আরেক নাম হতে পারে সহিষ্ণুতাই।
আদিম জীবনে গোষ্ঠীকে চিনেছিল মানুষ। কিন্তু যত তার পথ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়েছে, তত সে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে শিখেছে। সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বোধ জরুরি ছিল বইকি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে এখানেই যে, তার দরুন বেঁধে বেঁধে থাকার স্বাদ সে ক্রমে ভুলেছে। ব্যক্তির ক্রমাগত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা যে কখন অন্য ব্যক্তির মাথা চেপে ধরেছে, তা সে হয় দেখতে পায়নি, নয়তো দেখেও গুরুত্ব দেয়নি। ক্রমাগত নিজের গলা চড়িয়ে যাওয়া আসলে এই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠারই প্রকাশ। আর একের গলা যত চড়বে, অপরের কণ্ঠরোধ হবে ততই, সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই উনিশ শতকে ‘চেঁচিয়ে বলা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “কানটাই আমাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য হইয়াছে। কী যে বলিতেছে তাহা বড়ো একটা ভাবিয়া দেখে না, কেবল গলা খাটো না হইলেই হইল। কথাটা হয়তো বোঝাই হয় নাই, ভালো করিয়া শোনাই হয় নাই, হয়তো সে বিষয়ে কিছু জানাই নাই– কিন্তু আবশ্যক কী? জ্ঞানের অপেক্ষা বোধ করি অজ্ঞতার আওয়াজটা অধিক।” সেই চেঁচিয়ে বলার তোড় এই সময়ে আরও ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের। সে রাজনৈতিক মঞ্চে হোক কি প্রতিদিনের ব্যক্তিগত যাপনে। প্রতিদিনের জীবনে অন্যের কথা না শোনার অভ্যাস যে কী মারাত্মক অসহিষ্ণুতা ডেকে আনতে পারে, সে কথাও রবীন্দ্রনাথই বুঝিয়েছিলেন। ‘শাস্তি’ গল্প মনে করা যাক, যেখানে সারাদিন কাজ না পেয়ে বাড়ি ফিরে ভাত চাইছে ক্ষুধার্ত দুখিরাম। অথচ সেই দিন আনি দিন খাই ঘরে ভাতের জোগান কোথায়! দারিদ্র্যের দরুন মনও সেখানে গরিব হয়ে আসে। তাই অভুক্ত স্বামী ভাত চাইলে স্ত্রীর মুখে মিষ্টি কথা আসে না, বরং অভাবের হিসেব কষে চলা মনে আরও ঘা দেয় খাবার না-থাকার ক্ষোভ। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “গৃহিণীর রুক্ষবচন, বিশেষত শেষ কথাটার গোপন কুৎসিত শ্লেষ দুখিরামের হঠাৎ কেমন একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠিল। ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের ন্যায় গম্ভীর গর্জনে বলিয়া উঠিল, ‘কী বললি।’ বলিয়া মুহূর্তের মধ্যে দা লইয়া কিছু না ভাবিয়া একেবারে স্ত্রীর মাথায় বসাইয়া দিল।’’ এও তো না-শোনাই। পারিবারিক কলহ, ঘরে অন্ন না থাকা, কোনও কিছু না শুনেই নিজের সমস্ত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে পুরুষ। বস্তুত, স্ত্রী, বা কোনও নারীর কথা শোনার ক্ষেত্রেই একরকমের অসহিষ্ণুতা রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার। সেই প্রবণতায় বিশ্বাসী পুরুষ ক্রমাগত গলা তুলতেই চায়, নিজের মত অন্যের উপরে চাপিয়ে দিতে চায় সর্বতোভাবে, কিন্তু নারীর কথা শুনতে সে নারাজ।
পারিবারিক জীবনে এই না-শোনার অভ্যাস যেমন অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়, তেমনই সামাজিক জীবনেও না-শোনা আরও বড় এক ব্যাধি। সম্প্রতি ভোটের বাজারে দেখা গিয়েছে, কীভাবে একে অপরের প্রতি নির্দ্বিধায় ঘৃণাভাষণ ছুড়ে দিয়েছেন নেতারা। কীভাবে আমজনতা কী চায়, সে কথা ক্রমশ চাপা পড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে নেতাদের কোনও কাজের বিরোধিতা করলে তো আর কথাই নেই। সে বিরোধিতা কেন আসছে, বিরোধিতার মূল সূত্রটিই বা কী, সে কথা শোনার অভ্যাস হারিয়ে গিয়েছে বহুদিন। অথচ ভারতীয় সংস্কৃতি বলছে, তর্কশীলতার যথার্থ ঐতিহ্য এ দেশে ছিল। সেই তর্কপ্রিয় ভারত-এর কথা লিখেছেন অমর্ত্য সেন, যে ভারতবর্ষ অপরের মত শোনে এবং শোনে বলেই তা নিয়ে তর্ক করে। বছর পঞ্চাশ আগেও বিহারে, কোনও শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে বিরোধী মতের পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে আনা হত। দুটি বিরোধী মতের মধ্যে তর্ক হবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। এবং সে তর্ক শুনতেন উপস্থিত অতিথি অভ্যাগতেরা। ভারতীয় রসতত্ত্বের অন্যতম দিকনির্দেশক অভিনবগুপ্ত নিজে ছিলেন নিষ্ঠাবান শৈব, তিনি বলছেন, বৌদ্ধদের সঙ্গে তর্ক না করলে আমাদের শৈব-শাক্ত শাস্ত্র তৈরি হত না। পূর্বপক্ষের, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের ঘর থেকে আমাদের অনেক কিছু গ্রহণ করার রয়েছে। মনে রাখতে হবে, বৌদ্ধরা আত্মা বা ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তাঁদের থেকে জ্ঞান আহরণ করছেন শৈব অভিনবগুপ্ত। ভিন্ন মত শোনা, তার বিষয়ে কৌতূহল, প্রয়োজনে তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, ভারতে সহিষ্ণুতার এই হল লক্ষণ। তাই পরের ধর্ম ও উপাসনাবিধিকে যারা নিন্দে করে, নিজের গীতাভাষ্যে সেই পণ্ডিত-ধার্মিকদের কড়া সমালোচনা করে গিয়েছেন অভিনবগুপ্ত। একের বলা ও অপরের শোনার মধ্যে দিয়ে যে আদানপ্রদানের পাঠ দিয়েছিল প্রাচীন ভারতবর্ষ, সেই ধারাটিই একালের উদগ্র রাজনীতির কলরবে অন্তঃসলিলা।
এ প্রসঙ্গেই এক রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত মনে করে নেওয়া যাক। বছর কয়েক আগে কিউবা সফরে গিয়ে গণতন্ত্র নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরি। আমেরিকা এবং কিউবার ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, সুতরাং মার্কিন বিদেশ সচিব কিউবায় গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করলে তা যে আদতে সে দেশের শাসনতন্ত্রের সমালোচনা, সে কথাও বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সে বক্তৃতায় বাধা পড়েনি, বরং জন কেরির ভাষণ সমান্তরাল ভাবে স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয় যাতে শ্রোতারা তা শুনে বুঝতে পারেন। শত্রুপক্ষ বলে সে সমালোচনা করলে শোনা হবে না, এই অভ্যাসের দাসত্ব থেকে সেদিন মুক্তির পথ দেখিয়েছিল কাস্ত্রোর দেশ। আর এহেন ঘটনাই নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, ভিন্ন মতের কথা বলা এবং শোনা এবং উভয়ের সংঘাতের মধ্যে দিয়েই আসলে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটা সম্ভব। অপরের মত সমর্থন করি না, তবু সে অপরের নিজের কথা বলার সম্পূর্ণ অধিকার আছে এবং সে কথা শোনাই আমাদেরও কর্তব্য– এই গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শুধু এ দেশে নয়, গোটা বিশ্বেই দুর্লভ হয়ে আসছে। সেই গণতন্ত্রকে জাগিয়ে রাখার জন্যই শোনার চর্চা জারি থাকুক।