বাহাদুর বিড়াল, কিংবা বিড়ালের বাহাদুরি সাহিত্যেও দিব্যি হাজির। যামিনী রায়ের ছবির সেই মাছ মুখে বিড়াল থেকে দেবাশীষ দেবের সব ছবির সদাজাগ্রত বিড়ালেরা যেমন আমাদের চেনা, তেমনই হ য ব র ল-র এক চোখ বোজা বিড়াল থেকে কমলাকান্তের বিড়াল মিলে বাংলা সাহিত্যেও গড়ে নিয়েছে এক বঙ্গীয় বিড়াল সমিতি। লিখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
ম্যাও ম্যাও হুলোদাদা, তোমার যে দেখা নাই! এ কথা সুকুমার রায় যতই বলুন না কেন, সাহিত্যের পক্ষে বলার জো নেই। সাহিত্যের আঙিনায় বিড়ালের অবাধ আনাগোনা। নিজেকে দীনদুনিয়ার মালিক মনে করা এই প্রাণীটি নিজেকে এ দুনিয়াতেও নিজের মতোই গুছিয়ে নিয়েছে। কবি এলিয়ট যেমন তাদের নামকরণ নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তেমনই ‘ওয়ান্ডারল্যান্ডে’ গিয়ে অ্যালিসের দেখা সেই চেশায়ার ক্যাটকে ভোলার সাধ্য কার! সে অদৃশ্য হয়ে গেলেও আকাশ জুড়ে বিছিয়ে থাকত তার হাসি। আবার সুকুমার রায় লেখেন খিলখিল্লির মুল্লুকের দুই বিড়ালের গল্প, ঝগড়া থেকে শুরু করে হাতাহাতি হয়ে শেষ পর্যন্ত যাদের দুখানি ল্যাজের ডগা ছাড়া আর কিছুই পড়ে ছিল না। বলাই বাহুল্য, বাংলার বইদুনিয়াতে দিব্যি গড়ে উঠেছে এক বঙ্গীয় বিড়াল সমিতিও।
তা আর হবে না! এ ভাষাতেই যে লেখা হয় ‘বেড়ালের বই’। আজ্ঞে হ্যাঁ, এ বইতেই লীলা মজুমদার লিখেছিলেন কালো বিড়াল, ধলা বিড়াল, ছাই বিড়ালদের সব গল্প। তাঁর জীবনের সবচেয়ে আরামের জায়গাটি তাঁর মায়ের বাড়ি। সেই শিলংয়ের বাড়িতেও রাতে ঘুমের মধ্যে ঠান্ডা লাগলে পায়ে ঠেকত কী একটা নরম গরম জিনিস। পরে বোঝা গেল তা আদতে স্কাইলাইট দিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে ঢোকা ছাই রঙের হুলো। পাশের বাড়ির সাহেবের দুই বিলিতি বেড়ালকে সেই ছাই বিড়াল এমন তাড়া করেছিল একদিন, যে, বিলিতি শিক্ষা ভুলে সোজা গাছের মগডালে চড়ে বসে তারা। শেষে তাদের উদ্ধার করতে সাহেবের বেয়ারাকে গাছে মই লাগিয়ে বিড়াল নামাতে হয়। তাঁর লেখা ‘আষাঢ়ে গল্পে’ও গাছে চড়ে বসে আর বাড়ি ফেরার পথ পাচ্ছিল না গয়লানি মাসির ক্ষীর-ননী খাওয়া বিড়ালেরা।
অবশ্য বিড়াল উদ্ধার করতে দমকলের মই পর্যন্ত হেঁকেডেকে হাজির করেছিলেন নবনীতা দেবসেন। ‘মঁসিয়ে হুলোর হলিডে’-র সেই বেড়ালও পাশের সাহেবি বাড়ির অ্যালসেশিয়ানকে তোয়াক্কা না করে তার বরাদ্দ মাংসটুকু খেয়ে যেত রোজ রোজ। শিবানী রায়চৌধুরীর গল্পের বেড়ালেরা আবার ইচ্ছে করেই হারিয়ে যায় একেকজন। মা-বাবা-দিদির আদরে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে উঠতে কেউ হঠাৎ আয়নায় মুখ দেখে টের পায়, সে আদতে বেড়াল। কেউ আবার নন্দলাল জিউ লেনের ফুটপাথের ঝুপড়িতে দিব্যি ছিল, কিন্তু বিপত্তিটা বাধে লোভে পড়ে রামবল খেতে গিয়ে। মশগুল নামের সেই বিড়ালের আবার ছিল বিরাট কিছু হয়ে ওঠার ইচ্ছেও। শেষ পর্যন্ত ম্যাজিশিয়ান মিস্টার ফনফনিয়ার ইচ্ছেপূরণ বাক্সে ঢুকে সে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হয়ে উঠল কি না, সে গল্পই লিখেছিলেন শিবানী। তবে সুকুমার রায় যখন রুমাল থেকেই বেড়াল করে তোলার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন আমাদের, তখন এ-ই বা আর আশ্চর্যের কী! লীলা মজুমদারের নেপো কিংবা সুবিমল রায়ের ‘স্বদেশলাল’ও তো বানিয়েছিল বিড়ালের হারমোনিয়াম! তবে কারিগরের বানানো কাঠের হারমোনিয়ামের খাঁজে খাঁজে লেজ গোঁজা বিড়ালরা একদিন বিদ্রোহ করে বসল। স্বদেশলাল সে দিন নাকে খত দিয়ে বললে, ‘আমার বিড়াল শিষ্যেরা আমাকে আজ ক্ষমা করুক আর শান্তিতে থাকুক!’
এরা অবশ্য তুলনায় বেশ কাঁচা বয়সের। তবে বাংলা সাহিত্যের বিড়াল দুনিয়ায় বর্ষীয়ানদের সংখ্যাও কম নেই। কমলাকান্তের দুধের বাটিতে চুমুক দিয়ে ‘ক্ষুদ্র মার্জার’-এর আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন খোদ বঙ্কিমচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথের ‘অভ্যর্থনা’ গল্পে চতুর্ভুজবাবু এমএ পাশ করে গ্রামে ফেরেন, এদিকে লোকের নজর তাঁর চেয়ে বেশি পড়ে সঙ্গের মোটাসোটা কাবুলি বিড়ালটির দিকেই। আর জীবনানন্দ দাশ তো বলেই গিয়েছেন, “সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়/ গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে…”
উপেন্দ্রকিশোর যে বিড়ালের কথা লিখেছিলেন, ঘুরঘুর করত সেও। তবে টুনটুনির ছানা খাওয়ার লোভে। কিন্তু যেদিন টুনটুনির ছানারা ডানা মেলে উড়তে পারল, সেদিন বিড়াল এসে ডাক দিতেই টুনটুনি পা উঁচিয়ে তাকে বলল, “দূর হ’ লক্ষ্মীছাড়ি বিড়ালনী!” আবার গয়লাবাড়ির দুধ, ছানা, ক্ষীর খাওয়ার লোভে বন্ধু বিড়ালকে মেরেই ফেলে ধূর্ত মজন্তালি সরকার। এই বিশ্বাসঘাতকতার উলটোদিকে হাজির প্রফেসর শঙ্কুর নিউটন, তাঁর সারাজীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী। ব্রাউন সাহেবের সাইমন তো কেবল জীবন নয়, মৃত্যুর পরেও তার মালিকের কাছেই ফিরে আসে। আর এক অসম বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে থাকে বাংলার সাহিত্যদুনিয়াও।