কখনও লাটসাহেবের বাড়ি। কখনও আবার জাতীয় গ্রন্থাগার। কতরকম ভূমিকাতেই যে অবতীর্ণ হয়েছে কলকাতা শহরের এই বিশেষ বাড়িটি। এমনকি, প্রেমের জন্য ডুয়েল লড়ার রণাঙ্গন হিসেবেও সাক্ষী দিতে পারে এই বাড়ি। খাস কলকাতায় এমন বিলিতি বন্দুকবাজি করেছিলেন কারা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
প্রেমে পড়লে মানুষ কী না করতে পারে! নিজের প্রাণ বাজি রাখতেও দ্বিধা করে না বুঝি। আর প্রেমের সঙ্গে যখন মিশে যায় পৌরুষের অহংকার? তখন প্রেমিক নাকি আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। ভালবাসা, বন্ধুত্ব, সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে তখন জেগে থাকে কেবল জেদ আর অধিকারবোধ। অন্তত তেমনটাই ঘটেছিল কলকাতার বুকে, আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে। প্রেমের জন্য ডুয়েল লড়তে নেমেছিলেন ব্রিটিশরাজের দুই ক্ষমতাশালী পুরুষ। একজন তখনকার ব্রিটিশ উপনিবেশ কলকাতার বড়লাট, ওয়ারেন হেস্টিংস। অন্যজন হেস্টিংস-এর চেয়ে আট বছরের ছোট ফিলিপ ফ্রান্সিস, বেঙ্গল সুপ্রিম কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। ১৭৮১ সালের ১৭ আগস্ট সকালে প্রশাসনের এই দুই কর্তাব্যক্তির ডুয়েলের সাক্ষী ছিল বেলভেডিয়ার ভবন, অর্থাৎ আজকের ন্যাশনাল লাইব্রেরি।
আরও শুনুন: ফাঁসি দিত ইংরেজরা, রাস্তার ধারে ঝুলত মৃতদেহ, কলকাতার সেই রাস্তার নাম কী জানেন?
আলিপুরের অভিজাত বেলভিডিয়ার গার্ডেন হাউস অবশ্য ক্ষমতার লড়াই দেখেছে আগেও। দেখেছে হাতবদল। কেউ বলেন এর প্রথম মালিক ছিলেন অওরঙ্গজেবের নাতি এবং প্রথম বাহাদুর শাহ জাফরের ছেলে আজিম-উস-শান, যিনি একসময় বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবেদার ছিলেন। তবে অনেকেরই মত, এই প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর। ইংরেজদের অঙ্গুলিহেলনে যেমন সিংহাসনে বসেছিলেন, তেমনই মসনদ হারাতেও হয়েছিল। রাজমুকুট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘আলিপুর’-এর নামকরণ করেছিলেন তিনি। শোনা যায় তিনিই নাকি এই প্রাসাদ তৈরি করে উপহার দিয়েছিলেন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস-কে। আর এই প্রাসাদেই পাকাপাকিভাবে বাস করতে শুরু করেন হেস্টিংস। তাঁর সঙ্গে এদেশে এসেছিলেন জার্মান ব্যারনেস মারিয়ান ভন ইনহফ। শোনা যায়, সুন্দরী ব্যারনেসকে কেন্দ্র করেই নাকি এমন বিবাদ বেধেছিল হেস্টিংস আর ফ্রান্সিসের মধ্যে যে তা গড়িয়ে গিয়েছিল ডুয়েল পর্যন্ত। বেলভিডিয়ার হাউসের গা-ঘেঁষা রাস্তাটিতেই আয়োজন করা হয়েছিল সেই ডুয়েলের।
আরও শুনুন: পিয়ানো বাজান, ঘোড়াও চড়েন… কলকাতার পুরনো বাড়িতে এখনও নাকি দেখা মেলে ‘তেনাদের’
ডুয়েলের নিয়ম হল, একইসঙ্গে দুই প্রতিপক্ষ এ ওর দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়ান। ট্রিগারে চাপ দেন একইসঙ্গে। যিনি আহত হন বা মারা পড়েন, বলাই বাহুল্য, তিনিই পরাজিত হন এ লড়াইয়ে। হেস্টিংস আর ফ্রান্সিসের দ্বন্দ্বযুদ্ধে হেস্টিংসের গুলি আহত করেছিল ফ্রান্সিসকে। আঘাত মারাত্মক ছিল না, বেলভিডিয়ার হাউসেই নাকি তাঁর শুশ্রূষা হয়েছিল। তবে এর ফলে কেবল হেস্টিংস-এর ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও বড়সড় তফাত ঘটে গিয়েছিল। যে ফিলিপ ফ্রান্সিস কাউন্সিলে হেস্টিংস-এর অধিকাংশ প্রস্তাবকেই বিরোধিতা করে ফেলে দিতেন, তিনি এই ডুয়েলের পর পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে যান। কারও কারও মতে, ব্যারনেসকে বিয়ে করা নিয়ে নয়, আসলে রাজনৈতিক বিরোধ থেকেই এই ডুয়েল ঘটেছিল। যাই হোক না কেন, এই কুখ্যাত ডুয়েলের গল্প মিলেমিশে রয়ে গিয়েছে কলকাতার পুরনো গল্পদের সঙ্গেই।